
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
দেশে বর্তমানে ১ কোটি ১৮ লাখের বেশি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা ইউনিট রয়েছে, যার মধ্যে স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিটের সংখ্যা ৬২ লাখ ৮৮ হাজারের বেশি। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতায় নিবন্ধিত ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৫ লাখ ৫৭ হাজার। এ হিসাবে, দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিট এখনো করজালের বাইরে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি দেশের রাজস্ব ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতার অন্যতম উদাহরণ। এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব এবং কর আহরণের নিম্ন হারকে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। কর-জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম নিম্ন অবস্থানে রয়েছে, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল ও পাকিস্তানের চেয়েও পিছিয়ে। বর্তমানে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৭-৮ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে, যা অর্থনীতির টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য অপর্যাপ্ত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারির তথ্যমতে, দেশের স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ৬২ লাখ ৪৪ হাজার ২১৪, যার মধ্যে গ্রামাঞ্চলে রয়েছে ৩৯ লাখ এবং শহরে ২৩ লাখ। তবে এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) বা ভ্যাট নিবন্ধনধারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৫ লাখ ৫৭ হাজার। এর অর্থ, স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোর ৯০ শতাংশেরও বেশি এখনো ভ্যাট নিবন্ধনের আওতায় আসেনি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানো হলে কর-রাজস্ব আহরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো হলে কর-রাজস্ব আহরণের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে যেতে হবে না। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও বিআইএন নম্বর সংযুক্ত থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর আহরণ করা সম্ভব হবে।’
বর্তমান মূসক আইনে দেশের প্রতিটি অর্থনৈতিক ইউনিটের জন্য মূসক নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এনবিআরের নীতিমালা অনুযায়ী, বার্ষিক টার্নওভার ৩০ লাখ টাকার নিচে হলে কোনো ভ্যাট দিতে হয় না। ৩০-৫০ লাখ টাকার মধ্যে হলে ৩ শতাংশ এবং ৫০ লাখ টাকার বেশি হলে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়। তবে এখনো বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এ নীতিমালার আওতায় আসেনি।
ভ্যাট নিবন্ধনের বাইরে থাকা শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জুয়েলারি খাত। বর্তমানে দেশে প্রায় ৪০ হাজার জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সদস্য সংখ্যা ২৩ হাজার। তবে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র আট হাজার, আর ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) স্থাপন করা হয়েছে মাত্র এক হাজারটিতে।
এনবিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশের সব জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে ইএফডি বা সেলস ডাটা কন্ট্রোলার (এসডিসি) স্থাপনের জন্য বাজুসকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এনবিআরের সদস্য (মূসক বাস্তবায়ন ও আইটি) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী জানান, ‘২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুয়েলারি খাতে ভ্যাট আহরণ হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। তাই ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসকে যথাক্রমে ভ্যাট নিবন্ধনের মাস ঘোষণা করা হয়েছে।’
এনবিআরের সাবেক সদস্য রেজাউল হাসান বলেন, ‘জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা কর প্রদানে অনীহা দেখিয়ে আসছেন। অতীতে কর সংক্রান্ত নীতিমালা প্রয়োগ করতে গেলে তারা দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। অটোমেশন কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।’
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের কর ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্য করের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার বলেন, ‘করজাল সম্প্রসারণ করতে না পারার ব্যর্থতার কথা সর্বমহলে আলোচিত। কর ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন এনে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে।’
এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, সংস্থাটির মোট ভ্যাট আহরণের ২৫ শতাংশ আসে তামাকজাত পণ্য থেকে। তবে অননুমোদিত বিক্রি ও বিপণন বৃদ্ধি পাওয়ায় এ খাত থেকেও প্রত্যাশিত রাজস্ব আহরণ সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অবৈধ বাজার বন্ধে এনবিআর দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিবিএসের পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত সব অর্থনৈতিক ইউনিট ভ্যাটযোগ্য নয়। এনবিআরের সদস্য (মূসক নীতি) ড. মো. আব্দুর রউফ বলেন, ‘উৎপাদনকারী, আমদানিকারক ও রফতানিকারকদের প্রায় সবাই নিবন্ধিত থাকলেও ট্রেডার ও সেবা প্রদানকারীদের একটি বড় অংশ এখনো অনিবন্ধিত রয়েছে। এসব ব্যবসায়ী সমিতির কারণে নিবন্ধন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক খাতের তুলনায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আকার বড় হওয়ায় করজালের বাইরে থাকা অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা বেশি। শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, দেশে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে রয়েছে, আর বাকি ৮৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত।
এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো ও করজাল সম্প্রসারণের জন্য বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন। কর ও ভ্যাট আদায়ের প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল মাধ্যমে নিয়ে আসলে রাজস্ব আহরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সম্ভব হবে বলে তারা মনে করেন।
repoter