ছবি: ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে চীনা অর্থায়নে বাস্তবায়িত মেগা প্রকল্পগুলোর সিংহভাগই গত দেড় দশকে নির্মাণ হয়েছে, আর কিছু প্রকল্প এখনও বাস্তবায়নাধীন। এগুলোর জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষ যখন ঋণ গ্রহণ করেছিল, তখন বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রকল্পগুলোর আর্থিক মুনাফাযোগ্যতার দাবি করা হয়েছিল। তবে প্রকল্পগুলো চালু হওয়ার পর থেকে দেখা যাচ্ছে, বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অধিকাংশ প্রকল্পের আয় দিয়ে তাদের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও উঠছে না, বরং ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ হারিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর থেকে চীন বাংলাদেশকে প্রায় ১ হাজার ১০৫ কোটি ডলার ঋণ ও বাজেট সহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এর মধ্যে ৭৭৫ কোটি ডলার ছাড় করা হয়েছে এবং এই অর্থে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে, বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর অধিকাংশেরই অর্থনৈতিক ফলাফল প্রত্যাশিত নয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, যার ব্যয় প্রায় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা, এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। যদিও প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে, তার আয় দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না এবং ভর্তুকি দিতে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে।
পদ্মা রেলপথের মাধ্যমে ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও, প্রথম ছয় মাসে আয় হয়েছে মাত্র ৩৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা, যা ঋণের কিস্তি ও অন্যান্য খরচের তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রকল্পটির ঋণ পরিশোধে ভর্তুকি দিতে হবে, এবং এই প্রকল্প লাভজনক হওয়ার জন্য কিছুদিন সময় লাগবে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, এসব প্রকল্পে বৃহত্তর আঞ্চলিক পরিকল্পনার অভাব এবং প্রয়োজনীয় শিল্পায়নের পরিকল্পনা না থাকায় আর্থিক কর্মচাঞ্চল্য তৈরির লক্ষ্যে প্রকল্পগুলো সফল হচ্ছে না।
আরেকটি বড় প্রকল্প, পায়রা আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যেটি বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত হয়েছে, তারও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। জ্বালানি সরবরাহের জন্য পায়রা বন্দরে নৌযান চলাচল করতে না পারায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিচালনা খরচ বেড়েছে এবং উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে, চ্যানেলের গভীরতা কমে যাওয়ায় বড় জাহাজ এসে কয়লা আনতে পারছে না, যার ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋণে নির্মিত এই প্রকল্পটির মোট ব্যয় ২৪১ কোটি ডলার। তবে, এ ধরনের প্রকল্পে লাভের প্রত্যাশা কিছুটা কম, এবং দেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট অবদান রাখার প্রশ্নে বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। কিছু প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক লাভ, তবে এটি আর্থিক দিক দিয়ে সফল হয়নি। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেছেন, এই প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্যতা বিচার না করে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই এগুলো গ্রহণ করা হয়েছে।
তবে আরও কিছু প্রকল্প, যেমন কর্ণফুলী টানেল, এখনও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়ে উঠতে পারেনি। প্রকল্পটির ব্যয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা চীনের ঋণ। টানেলটি চালু হওয়ার পর এক বছরে আয় হয়েছে মাত্র ৩৭ কোটি টাকা, অথচ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ১৩৬ কোটি টাকার বেশি। সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রকল্পটি লাভজনক হতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে, চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়ায় টানেলের আয় বাড়ছে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব প্রকল্প পরিকল্পনার সময় প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্যতা সঠিকভাবে যাচাই করা হয়নি, এবং এসব প্রকল্প জাতীয় স্বার্থের চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেছেন, এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন ছিল শুধুমাত্র অর্থের লুটের উদ্দেশ্যে, যার কারণে পরবর্তীতে বাংলাদেশের জন্য তা বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই প্রকল্পগুলো থেকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার আর্থিক লাভ পাওয়া যায়নি। বরং, প্রত্যাশিত আয় না হওয়ায়, ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মেটাতে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ খরচ হচ্ছে। এক্ষেত্রে, চীন এবং বাংলাদেশের মধ্যে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়নে যে রাজনৈতিক ও আর্থিক বিচ্যুতি ঘটেছে, তা ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
repoter