
ছবি: -সংগৃহীত ছবি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের হঠাৎ নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছে নেপাল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার দাবিতে রাস্তায় নামা ছাত্র-জনতার আন্দোলন অল্প সময়েই পরিণত হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। রাজধানী কাঠমান্ডুর রাজপথ এখন পরিণত হয়েছে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তার কেন্দ্রবিন্দুতে।
সোমবার সকাল থেকেই নিউ বানেশ্বর এলাকায় ছোট ছোট দলে জড়ো হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও তরুণরা। হাতে ছিল নানা স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড—“দুর্নীতির অবসান চাই”, “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দাও”, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ মানি না”। শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা দিয়ে শুরু হলেও দুপুর নাগাদ পরিস্থিতি পাল্টে যায়। অভিযোগ ওঠে, একদল বিক্ষোভকারী হঠাৎ করে ফেডারেল পার্লামেন্টের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। প্রথমে ব্যারিকেড দিয়ে ঠেকাতে চেয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনী, কিন্তু ব্যর্থ হলে ব্যবহার করা হয় টিয়ার গ্যাস, পানি কামান এবং রাবার বুলেট। পরে গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ।
এই আন্দোলনের তাৎক্ষণিক উদ্দীপক ছিল সরকারের ঘোষণা। কয়েক সপ্তাহ আগে প্রশাসন জানিয়েছিল, ভুয়া খবর ও রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা রোধে কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। গত বৃহস্পতিবার সরকার জানায়, নিবন্ধনপ্রক্রিয়ায় অংশ না নেওয়ায় ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার), ইউটিউবসহ জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকেই সরাসরি কণ্ঠরোধ হিসেবে দেখেছে তরুণ প্রজন্ম।
ডিজিটাল যুগে বেড়ে ওঠা নেপালের জেনারেশন জেড-এর কাছে ফেসবুক, টিকটক কিংবা ইনস্টাগ্রাম কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং রাজনৈতিক আলোচনা, সংগঠিত হওয়া এবং প্রতিবাদের প্ল্যাটফর্ম। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্ত তাদের ক্ষোভকে বিস্ফোরিত করেছে।
প্রথমে সংসদ ভবনের বাইরে অবস্থান কর্মসূচি দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শহরের নানা প্রান্ত থেকে সাধারণ মানুষও যোগ দেন। বেকার যুবক, ছোট ব্যবসায়ী, এমনকি কিছু সরকারি চাকরিজীবীও ভিড়ের মধ্যে ছিলেন। তাদের অভিযোগ, বছরের পর বছর দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর অকার্যকর নীতি দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। শিক্ষিত তরুণেরা চাকরি পাচ্ছেন না, সরকারি সেবাখাতে অনিয়মে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ, অথচ রাজনীতিবিদদের মধ্যে নেই জবাবদিহি। দীর্ঘদিনের এই ক্ষোভই আন্দোলনে রূপ নেয়।
সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৪ জন, আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক। আহতদের মধ্যে আছেন সাংবাদিক, ক্যামেরাপার্সন ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও। অনেকেই গুরুতর আঘাত পেয়েছেন মাথায়, চোখে ও বুকে।
প্রশাসনের দাবি, আন্দোলনকারীরাই প্রথম পুলিশের ওপর হামলা চালায় এবং সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করে। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ মিছিলেই প্রথম টিয়ার গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। এতে জনতার মধ্যে ভীতি ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয় এবং পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
সংঘর্ষের পর কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন বেশ কয়েকটি এলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করেছে। মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী। তবে কারফিউ ভেঙেই রাস্তায় নেমে আসছে ছাত্র-জনতা।
ঘটনার পর নেপালের রাজনৈতিক অঙ্গনও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলগুলো সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে এবং মৃত্যুর জন্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দায়ী করছে। অন্যদিকে, সরকার বলছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেই এই পদক্ষেপ।
নাগরিক সমাজের একাংশ মনে করছে, এটি কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের প্রতিবাদ নয়, বরং দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশ। বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক স্থবিরতা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা একসঙ্গে মিশে বিস্ফোরিত হয়েছে।
তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবার নেপালের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক ইতিহাসে ছাত্র-যুবাদের এমন দৃপ্ত ও সরব উপস্থিতি নজিরবিহীন। যদি সরকার তাদের কণ্ঠস্বর উপেক্ষা করে, তবে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষ নেপালের রাজনীতিতে নতুন মোড় যোগ করেছে। এখন প্রশ্ন হলো—সরকার কি সংলাপ ও সমঝোতার পথে হাঁটবে, নাকি দমননীতিই হবে পরবর্তী কৌশল? সময়ই বলে দেবে, এই তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভ নেপালের গণতন্ত্রকে নতুন আলোয় উজ্জ্বল করবে, নাকি দেশকে আরও গভীর অস্থিরতায় ঠেলে দেবে।
repoter