
ছবি: -সংগৃহীত ছবি
রাজধানীতে আলোচিত জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ আগামী অক্টোবর মাসের মধ্যে শেষ হতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম।
রবিবার (১৭ আগস্ট) দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তার বাইরে যেসব সাক্ষী আছেন, তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ সেপ্টেম্বর মাসেই শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খুব বেশি হলে এটি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গড়াতে পারে।
প্রসিকিউটর মিজানুল জানান, বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে ট্রাইব্যুনাল-১ এ, যেখানে চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেল কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ইতোমধ্যে মামলার চতুর্থ দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এদিন দুজন সাক্ষী, সবজি বিক্রেতা আবদুস সামাদ ও মিজান মিয়ার সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয়। রাষ্ট্রপক্ষে নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন তাদের জেরা করেন।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের হয়ে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম ও প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ আরও অনেকে। রোববার সকালে মামলার অন্যতম আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ।
উল্লেখ্য, গত ১০ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেওয়া হয়। মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে সহযোগিতা করতে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেছিলেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, যা আদালত মঞ্জুর করে।
এর আগে, গত ১৬ জুন ট্রাইব্যুনাল-১ পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে হাজির হওয়ার জন্য একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছিল। পরদিন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলে তাদের ৭ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। তবে বিজ্ঞপ্তির পরও তারা আদালতে হাজির না হওয়ায় রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে অভিযোগ গঠনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয় এবং ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন শেষে বিচার শুরু হয়।
প্রসঙ্গত, গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল-১। প্রসিকিউশন পাঁচটি পৃথক অভিযোগ উত্থাপন করে, যা পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হয়। নতুনভাবে গঠিত এই ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলাটি দাখিল হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে, যা ‘মিস কেস’ বা বিবিধ মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়।
এই মামলার বাইরে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা বিচারাধীন। এর একটি গুম-খুনের অভিযোগ সম্পর্কিত, যা আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। অন্য মামলাটি রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের হয়েছে।
প্রসিকিউশনের দাবি, গত বছরের জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার, দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। এতে অসংখ্য মানুষ নিহত ও আহত হয়, যার কারণে এসব ঘটনা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে চলমান এই মামলাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষত, দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও শীর্ষস্থানীয় দুই সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে যাওয়ায় দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলে রায় ঘোষণার পথ প্রশস্ত হবে। প্রসিকিউশন পক্ষ আশাবাদী, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হবে এবং বিচার দ্রুত অগ্রসর হবে।
ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারা জানান, মামলার জটিলতা বিবেচনা করে এটি দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। তবে সাক্ষী-জেরা শেষ হয়ে গেলে আদালতের গতি অনেকটাই বাড়বে। তারা আরও জানান, এ মামলায় রাজসাক্ষীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, যেহেতু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য আদালতের সামনে উপস্থাপিত হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করে আসছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই দাবি বাস্তবে রূপ পেতে শুরু করেছে।
এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান থাকলেও আরও কয়েকটি মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গুম-খুনের অভিযোগ, যা দলীয় ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে সংঘটিত হয়েছিল বলে অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া শাপলা চত্বরের ঘটনার মামলাটিও সমান গুরুত্ব পাচ্ছে।
সবমিলিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা একযোগে বিচারাধীন। এর মাধ্যমে দেশ নতুন এক রাজনৈতিক ও বিচারিক বাস্তবতায় প্রবেশ করছে, যা ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।
repoter