ছবি: ছবি: সংগৃহীত
যাত্রাবাড়ীতে শাহীনুর বেগম হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার ইকবাল বাহারকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিল আদালত।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে একটি ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শাহীনুর বেগম নামে এক নারীর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ইকবাল বাহারকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। শনিবার বিকেলে ঢাকা মহানগর হাকিম মো. জুয়েল রানা জামিন আবেদন নাকচ করে এই আদেশ দেন।
এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক কাজী রমজানুল হক আসামি ইকবাল বাহারকে আদালতে হাজির করেন এবং তাকে রিমান্ডে না নিয়ে সরাসরি কারাগারে পাঠানোর আবেদন জানান। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জামিনের আবেদন করলে রাষ্ট্রপক্ষ তীব্র বিরোধিতা করে। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন না মঞ্জুর করে ইকবাল বাহারকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
ইকবাল বাহারকে শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বেইলি রোড এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তিনি মামলার এজাহারনামীয় ২৬ নম্বর আসামি। তার গ্রেফতার এবং আদালতের রায়ের পর এই মামলাটি নতুন করে জাতীয় আলোচনায় উঠে এসেছে।
মামলার অভিযোগপত্র অনুযায়ী, গত ২২ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন কাজলা ফুটওভার ব্রিজের নিচে একদল ছাত্র বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করছিল। আন্দোলনটি শান্তিপূর্ণ ছিল এবং এতে সাধারণ মানুষ, পথচারী ও আশপাশের অনেকেই সহানুভূতি প্রকাশ করেন। শাহীনুর বেগম নামের একজন নারী ওই সময় আন্দোলনরত ছাত্রদের মাঝে পানি বিতরণ করছিলেন।
আদালতে দাখিল করা অভিযোগ অনুযায়ী, আন্দোলন চলাকালে মামলার মূল অভিযুক্তদের নির্দেশে অন্যান্য আসামিরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে দেশীয় অস্ত্র, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট এবং গুলি ছুড়ে। এতে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেকেই আহত হন। শাহীনুর বেগমও এই হামলার শিকার হন। মাথায় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তিনি ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়েন।
সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের শিক্ষার্থীরা তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। এক মাস ৯ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে তিনি শেষ পর্যন্ত মারা যান।
এই ঘটনার পর শাহীনুর বেগমের মেয়ে হাবেজা আক্তার বাদী হয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ২৯৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ২৫০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটি দায়েরের পর থেকেই আলোচনায় আসে এবং একাধিক মানবাধিকার সংগঠন এই ঘটনার বিচার দাবি করে।
ইকবাল বাহার পুলিশ প্রশাসনের একজন পরিচিত মুখ। তিনি এক সময় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তাকে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ঢাকার রাজারবাগের টেলিকম অ্যান্ড ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগে (টিঅ্যান্ডআইএম) বদলি করা হয়। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নির্দেশনা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে, যা আদালতের রেকর্ডেও উঠে এসেছে।
সাবেক উচ্চপদস্থ একজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন মামলা এবং গ্রেফতারের ঘটনা দেশে বিরল। এতে প্রশাসনের ভেতরে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। আইনি মহল মনে করছে, এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রভাবশালী মহলের চোখে ‘পরীক্ষা’ হিসেবে দেখা হবে— আইন সবার জন্য সমান কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেছেন, ইকবাল বাহার নির্দোষ এবং তাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলায় জড়ানো হয়েছে। তারা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
এই মামলার পটভূমিতে থাকা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রসমাজের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সেই সময় একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দাবিতে কর্মসূচি পালিত হয়। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল— চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সংস্কার, উচ্চশিক্ষায় সমান সুযোগ এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গঠন।
শাহীনুর বেগম, যিনি নিজে আন্দোলনের অংশ নন, কেবল মানবিক কারণে শিক্ষার্থীদের পানি সরবরাহ করেছিলেন— তার এই মৃত্যু আন্দোলনটির মানবিক দিকটি সামনে নিয়ে আসে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং নাগরিক সমাজ তার মৃত্যুকে ‘রাষ্ট্রীয় সহিংসতার শিকার’ হিসেবে উল্লেখ করে বিচার দাবি করে আসছিল।
এই প্রেক্ষাপটে ইকবাল বাহারের গ্রেফতার এবং কারাগারে প্রেরণের আদেশ আন্দোলনকারীদের মাঝে নতুন করে আশাবাদ তৈরি করেছে। তবে মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দ্রুত হবে— সেটাই এখন দেখার বিষয়। দেশের ইতিহাসে প্রভাবশালী নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর অধিকাংশই সময়ের সঙ্গে ঝুলে থাকে বা রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়।
তবে ভুক্তভোগীর পরিবার এবং মামলার বাদী হাবেজা আক্তার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, তারা বিচারিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রাখতে চান এবং চান, একজন সাধারণ নারীর মৃত্যু যেন অবহেলায় ঢাকা পড়ে না যায়।
এই মামলা এখন নজরে দেশের সাধারণ মানুষ, নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের। ইকবাল বাহারের কারাগারে পাঠানোর আদেশের মধ্য দিয়ে এই মামলায় নতুন অধ্যায় শুরু হলো— যার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে দেশের আইনি ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ও ন্যায়ের মানদণ্ড।
repoter




