
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মামলায় সাবেক এসআই, কনস্টেবল, প্রক্টর ও ছাত্রনেতা অভিযুক্ত
রংপুরে ২০২২ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত গণঅভ্যুত্থানের সময় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত চার ব্যক্তিকে আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে। রবিবার সকালেই প্রিজনভ্যানযোগে তাদের আদালতে হাজির করা হয়।
ট্রাইব্যুনালে আনা চার আসামির মধ্যে রয়েছেন পুলিশের সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) আমির হোসেন, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম এবং ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা ইমরান চৌধুরী আকাশ। মামলার শুনানি পরিচালনা করছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত একটি বেঞ্চ।
প্রসিকিউশন সূত্রে জানা যায়, এই মামলার প্রেক্ষিতে আদালত এর আগে, গত ৯ এপ্রিল এক আদেশে চার আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়। সেই সঙ্গে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ১৫ জুনের মধ্যে দাখিল করার নির্দেশনাও দেন আদালত।
আবু সাঈদ হত্যার প্রেক্ষাপট হিসেবে উঠে এসেছে, ২০২২ সালের জুলাই মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষার্থীরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। রংপুরেও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে সামিল হন। সেই সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ।
মামলার তদন্তে উঠে এসেছে, আন্দোলন দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করা হয় এবং সেই সময় পুলিশ গুলি চালায়। তদন্তকারীদের দাবি অনুযায়ী, সাবেক উপপরিদর্শক আমির হোসেন ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় সরাসরি গুলি চালানোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর শরিফুল ইসলাম এবং স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী আকাশ ওই দিনের ঘটনায় ইন্ধন দিয়েছেন এবং পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের আদালতে হাজির করার সময় চার আসামির নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আদালত চত্বরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল। তাদের মুখে ছিল কোনো প্রতিক্রিয়া বা মন্তব্যহীন অভিব্যক্তি। আদালত শুনানির শুরুতেই আগের আদেশের ধারাবাহিকতায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১৫ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন।
এদিকে, আবু সাঈদের পরিবার থেকে জানানো হয়েছে, তারা দীর্ঘদিন ধরে এই মামলায় বিচার চেয়ে আসছেন। পরিবারের সদস্যরা আজ আদালতে উপস্থিত ছিলেন এবং বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি দেখে কিছুটা স্বস্তি প্রকাশ করেন। আবু সাঈদের বাবা গণমাধ্যমকে জানান, “আমার ছেলে কোনো অন্যায় করেনি। সে শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। এখন আমরা ন্যায়বিচার চাই।”
আন্দোলনের সময় নিহত আবু সাঈদ ছিলেন একজন সচেতন শিক্ষার্থী ও সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী যুবক। তার সহপাঠী ও বন্ধুরা জানিয়েছেন, তিনি বরাবরই বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং শিক্ষাঙ্গনে ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিতেন।
এ মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, চার আসামির বিরুদ্ধে যে প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে, তা অত্যন্ত গুরুতর। আদালত যদি তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেন এবং তা পর্যাপ্ত বলে বিবেচিত হয়, তাহলে পরবর্তী ধাপে চার্জ গঠন এবং বিচার কার্যক্রম শুরু হতে পারে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, যদিও এই ট্রাইব্যুনাল মূলত ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করে থাকে, তবে দেশের অভ্যন্তরীণ গুরুতর অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়েও কখনো কখনো সরকারের বিশেষ অনুমোদনে বিচারকার্য পরিচালিত হয়।
প্রসঙ্গত, আবু সাঈদ হত্যার পর সারা দেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বিক্ষোভ-মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একাধিকবার রংপুর শহরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন এবং এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।
এখন আদালতের নির্দেশ অনুসারে আগামী ১৫ জুনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে বিচারিক কার্যক্রমের পরবর্তী ধাপ শুরু হবে। দেশবাসীসহ আবু সাঈদের পরিবার অপেক্ষায় আছে—এই মামলায় যেন দ্রুত ও সঠিক বিচার নিশ্চিত হয়।
repoter