ছবি: ছবি: সংগৃহীত
ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় নিরাপদ আশ্রয়ে আয়াতুল্লাহ খামেনি, তিন জন আলেমকে সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করেছেন বলে দাবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের।
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাতের উত্তপ্ত আবহে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি দেশটির নেতৃত্ব কাঠামোর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদুলুর বরাতে জানা গেছে, তিনি নিরাপদ বাংকারে অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকেই ইরানের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তিনজন শীর্ষ আলেমকে মনোনীত করেছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, খামেনির এই সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের জীবনের নিরাপত্তা এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে এই মনোনয়ন ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস শনিবার এক প্রতিবেদনে জানায়, আয়াতুল্লাহ খামেনি বর্তমানে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন। তিনি সরাসরি কোনো ফোন, কম্পিউটার কিংবা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করছেন না। তার পক্ষ থেকে যোগাযোগ রক্ষা করছেন নির্ভরযোগ্য সহকারীরা, যারা সেনাপতিদের সঙ্গে সরাসরি বার্তা আদান-প্রদানের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, খামেনির বর্তমান অবস্থান একটি সুরক্ষিত বাংকারে, যেখানে তাকে চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব।
তিনি শুধু উত্তরসূরি নয়, সামরিক বাহিনীর নতুন নেতৃত্বের জন্যও বেশ কিছু কর্মকর্তার নাম সুপারিশ করেছেন বলে জানা গেছে। খবরে দাবি করা হয়েছে, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে খামেনিকে সরাসরি হত্যার হুমকি পাওয়ার পর এই জরুরি সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ইরানের শীর্ষ নেতৃত্বকে টার্গেট করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ও বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করেছে। সিনিয়র কর্মকর্তা ও সামরিক কমান্ডারদের মোবাইল ফোনসহ যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই— যে কোনো ধরনের অবস্থান চিহ্নিতকারী তথ্য ফাঁস রোধ করা এবং সম্ভাব্য ড্রোন বা স্যাটেলাইট হামলা এড়ানো।
এই ঘটনাগুলোর পটভূমিতে রয়েছে ১৩ জুন শুরু হওয়া ইসরায়েলি বিমান হামলা, যেখানে ইরানের সামরিক ও পরমাণু স্থাপনায় বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরান ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে। সংঘাতের ফলে দুই পক্ষেই প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, ইরানের হামলায় তাদের অন্তত ২৫ জন নাগরিক নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছে।
অন্যদিকে, ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি বিমান হামলায় দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৪৩০ জন নিহত এবং ৩,৫০০-এর বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার কার্যক্রম এখনও অব্যাহত রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক গবেষণা কেন্দ্র, ক্ষেপণাস্ত্র ডিপো এবং বেসামরিক ভবন আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন বেশ টালমাটাল। যেকোনো মুহূর্তে নেতৃত্বশূন্যতার আশঙ্কা থেকে জাতির ভবিষ্যৎ গঠন কাঠামো নিশ্চিত করতে খামেনির এই মনোনয়ন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও এই তিনজন আলেমের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি, তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, তাঁরা খামেনির ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা প্রভাবশালী ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা।
এছাড়াও ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড এবং বাসিজ বাহিনীর মধ্যেও নতুন করে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর ভেতরে নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রস্তাব খামেনির পক্ষ থেকে আসার পর সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন শাখায় নতুন করে কৌশলগত সমন্বয় সাধনের কাজ শুরু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই রদবদলের ফলে ভবিষ্যতে ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ধরন ও গঠনেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে পারে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, খামেনির এই মনোনয়ন এবং তাঁর বাংকারে চলে যাওয়ার খবর মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে এক ধরনের উদ্বেগের বার্তা বহন করছে। একদিকে এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ইরান সম্ভাব্য আরও বড় হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, অন্যদিকে এও স্পষ্ট করছে যে দেশটির শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেকে হুমকির মুখে দেখতে পাচ্ছে।
এদিকে, ইরানের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এই মনোনয়ন বা অবস্থান পরিবর্তন নিয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে সরকারি গণমাধ্যমগুলোতে খামেনির সাম্প্রতিক কোনো প্রকাশ্য বক্তব্য বা উপস্থিতির খবর প্রকাশ হয়নি। এই ‘নীরবতা’ আরও সন্দেহ ও উৎকণ্ঠা তৈরি করছে।
বিশ্ব রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, খামেনির অনুপস্থিতিতে দেশটিতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমীকরণ কীভাবে পাল্টে যেতে পারে, তা এখন থেকেই পর্যবেক্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছে। যদি খামেনির মনোনীত তিন আলেমের মধ্যে একজন ভবিষ্যতে তার স্থলাভিষিক্ত হন, তবে সেটি ইরানের পররাষ্ট্রনীতি, পরমাণু কর্মসূচি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তার সামরিক অবস্থানকে নতুন পথে পরিচালিত করতে পারে।
এই মুহূর্তে ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে অবস্থান— দুটোই এক সংকটজনক চূড়ায় পৌঁছেছে। এমন অবস্থায় দেশটির সর্বোচ্চ নেতার এই পদক্ষেপ দেশ ও আন্তর্জাতিক মহলে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা আগামী দিনগুলোতে স্পষ্ট হবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত, ইরান আর আগের অবস্থানে ফিরছে না— সে ভিন্ন এক নতুন বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
repoter

