ছবি: ছবি: সংগৃহীত
দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে রবিবার শেরে বাংলানগর থানায় মামলা করতে যাচ্ছে বিএনপির প্রতিনিধি দল।
দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ও অনিয়মের অভিযোগে সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগামীকাল রবিবার (২২ জুন) মামলার আবেদন দাখিল করা হবে।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান শনিবার সাংবাদিকদের জানান, "দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। নির্বাচনে অসাধু, পক্ষপাতদুষ্ট ও সংবিধান লঙ্ঘনকারী ভূমিকার কারণে এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।"
জানা গেছে, মামলার আবেদন দাখিলের আগে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে যাবে। এরপর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তারা শেরে বাংলানগর থানায় গিয়ে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন। তিন সদস্যের ওই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। প্রতিনিধি দলে আরও থাকবেন আইন বিষয়ক নেতারা।
বিএনপির অভিযোগ, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৮ সালের একাদশ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কমিশনের দায়িত্বে থাকা সিইসি ও সংশ্লিষ্ট কমিশনাররা সাংবিধানিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। তাদের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপি, সরকারপন্থী দলকে সহযোগিতা, বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের বাধা প্রদান ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার অভিযোগ রয়েছে।
দলটি মনে করে, এসব নির্বাচনে কমিশনের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং দেশের গণতন্ত্রের জন্য তা ছিল মারাত্মক হুমকি। সেই কারণেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান বিএনপি নেতারা।
অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে শায়রুল কবির বলেন, "তিনটি নির্বাচনের সময় দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনগুলো জনগণের ভোটাধিকার হরণে সরকারকে সহযোগিতা করেছে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার পথ সুগম করেছে। জনগণ তাদের ভোট দিতে পারেনি, শত শত প্রার্থী হয়রানির শিকার হয়েছেন। অথচ কমিশন ছিল নীরব দর্শক। বরং তারা প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিরোধী দলকে দমন করেছে। এসব অপরাধের দায়ে মামলা হচ্ছে।"
তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে। সে সময় নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল, ফলে ১৫৩টি আসনে প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা, প্রাণহানি এবং ভোটার অনুপস্থিতি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন তৎকালীন সিইসি কেএম নূরুল হুদা। সে নির্বাচন নিয়েও দেশজুড়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ ছিল, ব্যালট পেপার ছাপার আগেই রেজাল্ট ঠিক করা হয়েছিল, ভোটগ্রহণের আগেই অনেক কেন্দ্রে ব্যালট ভর্তি হয়ে যায়, এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে বিরোধী দলকে মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে। এবারও বিএনপি ও বেশ কিছু বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচনের দিন দেশের অনেক কেন্দ্রে ভোটারশূন্যতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সরকারি দল আওয়ামী লীগের জয় নিশ্চিত হলেও নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল থেকে সন্তুষ্টির কোনো সাড়া মেলেনি।
বিএনপি মনে করে, উপর্যুক্ত তিন সিইসি তাদের দায়িত্বের অপব্যবহার করেছেন এবং সাংবিধানিক শপথ ভঙ্গ করেছেন। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। মামলার মাধ্যমে এসব ঘটনার তদন্ত এবং বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে বিএনপি।
এ বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা এই মামলা শুধু প্রতিশোধ বা প্রতীকী প্রতিবাদের জন্য করছি না। আমাদের উদ্দেশ্য নির্বাচন ব্যবস্থাকে রক্ষা করা। দেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করা জরুরি।”
উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। তারা অভিযোগ পেয়েছে যে, দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনগুলো সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাতে জড়িত ছিল এবং তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যবহার হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, বিএনপির এই মামলা দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ এক মোড় তৈরি করতে পারে। কারণ, এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনের জবাবদিহিতার বিষয়টি সামনে এসেছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোতে কমিশনের ভূমিকা কেমন হবে—তা নিয়ে।
এদিকে সাবেক সিইসিদের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে বিভিন্ন সময় তারা তাদের কাজকে আইন ও সংবিধান অনুযায়ী সঠিক বলে দাবি করেছেন।
বিএনপির মামলার সিদ্ধান্ত দেশের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, যদি আদালত এসব মামলার কার্যক্রম শুরু করে, তবে নির্বাচন কমিশনের ভবিষ্যৎ আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। একই সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার একটি পথ খুলে যেতে পারে।
রবিবার মামলার আবেদনপত্র জমা পড়লে মামলার বিস্তারিত অভিযোগপত্র এবং আদালতের পদক্ষেপের অপেক্ষায় থাকবে গোটা রাজনৈতিক মহল। এখন দেখার বিষয়, এই মামলায় কী ধরনের প্রতিক্রিয়া আসে রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক মহল থেকে।
repoter

