ছবি: -সংগৃহীত ছবি
রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) সকালে এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে। দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দিনটি শুরুতেই সেনাপ্রধান প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং পরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন।
সেনাপ্রধানের এ ধারাবাহিক সাক্ষাৎকে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং নিরাপত্তাজনিত বিষয়াবলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্রের বরাত দিয়ে জানা যায়, বৈঠকে সেনাপ্রধান তার সাম্প্রতিক চীন সফর সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত করেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে। সফরে চীনের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিনিময় এবং ভবিষ্যৎ কৌশলগত সম্পর্কের বিষয়ে যে আলোচনা হয়েছে, সেটির সারসংক্ষেপও বৈঠকে তুলে ধরেন তিনি।
চীন সফর বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে চীনের অবস্থান এবং আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-চীন সামরিক সম্পর্ক আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে। সেনাপ্রধানের এই সফর শুধু দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নয়, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা প্রদর্শনের একটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবেও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানোর মধ্য দিয়ে সরকারপ্রধানদের আস্থা অর্জন এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান স্পষ্ট করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে বৈঠকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক কর্মসূচি, বিভিন্ন স্থানে উত্তেজনা এবং সামাজিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোকপাত করা হয়। সেনাপ্রধান তুলে ধরেন, দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর সমন্বিত ভূমিকা কতটা জরুরি। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশকে শান্তিপূর্ণ রাখার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক আস্থার গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। তিনি সেনাপ্রধানকে বলেন, জনগণের আস্থা অর্জন এবং দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা অপরিহার্য। সেনাপ্রধানও এ বিষয়ে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে আলোচনা হয় দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে। বঙ্গভবনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, জাতির সংকটকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা জনগণের আস্থা অর্জনের প্রধান উপাদান। একইসঙ্গে তিনি সাম্প্রতিক চীন সফরের অভিজ্ঞতা এবং তার সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে সরাসরি সেনাপ্রধানের কাছ থেকে শোনেন।
এই বৈঠকগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়তে থাকায় বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে রাখতে হবে। সেই প্রেক্ষাপটে সেনাপ্রধানের চীন সফর এবং পরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা একটি কূটনৈতিক বার্তা হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বাংলাদেশে যখনই রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যায়, তখন সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা তীব্র হয়। যদিও সেনাপ্রধানের এই বৈঠক নিয়মিত আনুষ্ঠানিকতাও হতে পারে, তবুও বর্তমান পরিস্থিতিতে তা বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। এ ধরনের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা সেনাবাহিনীর অবস্থান ও কৌশলগত চিন্তাভাবনা সম্পর্কে সরাসরি অবহিত হতে পারেন।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো রাজনৈতিক বিভাজন এবং অর্থনৈতিক চাপে সৃষ্ট অসন্তোষ। এছাড়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে খাদ্য ও জ্বালানি সংকটও দেশের স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলছে। বৈঠকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কীভাবে কার্যকর সমন্বয় আনা যায়, সে বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে বঙ্গভবন ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় বৈঠকের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি প্রকাশ না করলেও রাজনৈতিক মহল ও কূটনৈতিক মহলে এ নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। অনেকেই মনে করছেন, সেনাপ্রধানের এই সাক্ষাৎ আসন্ন দিনগুলোর জন্য রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে।
সবশেষে বলা যায়, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাপ্রধানের পৃথক বৈঠক শুধু প্রাতিষ্ঠানিক নয়, বরং রাষ্ট্রের সামগ্রিক কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত অঙ্গনে এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টা। দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কৌশলগত অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে এই বৈঠক নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
repoter




