ছবি: -সংগৃহীত ছবি
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ আজ নানা সংকটের মুখে। অতিরিক্ত আহরণ, নদীর নাব্যতা হ্রাস ও ক্রমবর্ধমান দূষণের কারণে ইলিশের উৎপাদন ব্যাপকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, ইলিশ শুধু অর্থনীতির অংশ নয়, এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরও প্রতীক। তাই এর টেকসই সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের উদ্যোগে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী তৃতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ফরিদা আখতার বলেন, বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ হাওর সিলেট অঞ্চলে অবস্থিত। এই হাওর কেবল মাছের ভাণ্ডারই নয়, বরং গবাদি পশু, ছাগল এবং অন্যান্য প্রাণিসম্পদের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাই হাওরকে ঘিরে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করাকে জাতীয় অগ্রাধিকারের পর্যায়ে নিয়ে আসা সময়ের দাবি।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় মাছের বৈচিত্র্য রক্ষা করা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতে মুখ্য ভূমিকা রাখে। নিরাপদ মৎস্যচাষ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। স্থানীয় প্রজাতির সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে টেকসই মৎস্য খাত গড়ে তুলতে হবে।
মৎস্য উপদেষ্টা হাওরের গুরুত্বের দিকেও আলোকপাত করেন। তার মতে, হাওর হলো জীববৈচিত্র্যের এক বিশাল ভাণ্ডার। এখানে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর প্রাকৃতিক আবাসস্থল গড়ে উঠেছে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, হাওরের মাছের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এর মূল কারণ হিসেবে তিনি পরিবেশগত ক্ষতি, পানি প্রবাহের বাধা এবং অবৈধ জাল ব্যবহারের মতো বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেন।
তিনি বলেন, “হাওরকে যদি আমরা মাছের খনি বলি, তবে এই খনির সম্পদ রক্ষা করা এখন আমাদের বড় দায়িত্ব। উৎপাদন হ্রাসের কারণ চিহ্নিত করে তা সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।”
ফরিদা আখতার অবৈধ জালের ব্যবহার নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, চায়না বা কারেন্ট জাল দিয়ে যারা মাছ ধরে তারা প্রকৃত মৎস্যজীবী নন। কারণ এই পদ্ধতিতে মাছ ধরা কেবল অবৈধই নয়, বরং এটি মাছের প্রজননকে ধ্বংস করে এবং ভবিষ্যৎ উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
তিনি বলেন, “ইলিশসহ দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষায় আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। টেকসই উন্নয়নের নামে পরিবেশের ক্ষতি করা যাবে না। পরিবেশবান্ধব উপায়ে হাওর উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।”
আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর ড. এ টি এম মাহবুব-ই-ইলাহী, বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্র এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। বক্তারা সবাই একমত হন যে ইলিশ উৎপাদন এবং স্থানীয় মাছের সংরক্ষণ এখন জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
সম্মেলনে দেশের মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণে গবেষণা ও উদ্ভাবনী কার্যক্রম বাড়ানোর ওপরও জোর দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করেও বাংলাদেশের মৎস্য খাতকে এগিয়ে নিতে হবে।
ইলিশের সংকট শুধু একটি প্রজাতির ক্ষতি নয়, এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং মানুষের জীবনের সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত। তাই এ সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ, কার্যকর নীতিমালা এবং বাস্তবভিত্তিক গবেষণাই হতে পারে একমাত্র পথ।
repoter




