ছবি: পিটার নাভারো
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ঘিরে আবারও আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো। দীর্ঘদিন ধরেই নাভারোর মন্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এবারও তিনি ভারতের নীতি ও মোদির ভূমিকাকে সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ করে বক্তব্য রেখেছেন।
ফক্স নিউজকে দেওয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে নাভারো বলেন, “মোদি একজন ভালো নেতা, এ নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না যে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের নেতা হয়েও তিনি কেন ভ্লাদিমির পুতিন আর শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন। এ সিদ্ধান্ত শুধু ভারতের নয়, গোটা বিশ্বের জন্যও উদ্বেগজনক।”
তিনি ভারতের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আপনাদের বুঝতে হবে কি ঘটছে। ভারতের জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের মূল্যে কিছু গোষ্ঠী, বিশেষ করে উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণরা, মুনাফা করছে। এই পরিস্থিতি বদলানো জরুরি।” তার এই মন্তব্য ভারতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নাভারোর মন্তব্যে শুধু ভারত নয়, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলও অস্বস্তিতে পড়েছে।
পিটার নাভারো এর আগে একাধিকবার ভারতের সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে রাশিয়া থেকে তেল আমদানির কারণে তিনি ভারতের অবস্থান নিয়ে কঠোর মন্তব্য করেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু ভারত সেসব উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখে। এ বিষয়ে নাভারোর অভিযোগ, ভারত পরোক্ষভাবে রাশিয়াকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।
গত সপ্তাহে ব্লুমবার্গ টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও তিনি মোদিকে দোষারোপ করে বলেন, “এই যুদ্ধ আসলে পুতিন বা জেলেনস্কির নয়, এটি মোদির যুদ্ধ। কারণ, রাশিয়া থেকে তেল কিনে ভারত মস্কোর যুদ্ধযন্ত্রকে সচল রাখছে।” এ মন্তব্য তখনই তীব্র সমালোচনা কুড়ায়। বিশেষজ্ঞরা একে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক চাপে ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তারের কৌশল হিসেবে দেখছেন।
ট্রাম্প প্রশাসন ভারতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছিল, যা এখনও কার্যকর রয়েছে। রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর মোট ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসায়। হোয়াইট হাউসের দাবি ছিল, এ নীতির মাধ্যমে ভারতকে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানি বন্ধে বাধ্য করা হবে। যদিও ভারত তার অবস্থানে অনড় থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় অটল থাকে।
ভারতের সরকার বারবার বলেছে, দেশের জনগণের প্রয়োজন ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা করে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখা হয়েছে। বিশেষত, বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের সময় ভারতীয় অর্থনীতি রক্ষার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে তেল সংগ্রহ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। এ অবস্থান ভারতের জন্য কৌশলগত হলেও পশ্চিমা বিশ্বে তা অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, পিটার নাভারোর মন্তব্য শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বৃহত্তর কূটনৈতিক সংকেত। যদিও ট্রাম্প এখন আর প্রেসিডেন্ট নন, তবে তার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারা প্রভাব বিস্তার করতে চাইছেন। অনেকের মতে, ট্রাম্প আবারও নির্বাচনী ময়দানে সক্রিয় হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাই তার দলের কৌশলগত বার্তা দেওয়ার জন্য নাভারোর মতো ব্যক্তিদের ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভারতে নাভারোর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়াও মিশ্র। মোদির সমর্থকরা বলছেন, এটি শুধু রাজনৈতিক ঈর্ষা ও কূটনৈতিক চাপের প্রকাশ। তাদের দাবি, ভারত এখন আর আগের মতো নির্ভরশীল নয়, বরং বিশ্বশক্তি হিসেবে উঠে আসছে। সেই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু নীতিনির্ধারক ভারতের স্বাধীন অবস্থানকে মেনে নিতে পারছেন না। অন্যদিকে বিরোধীরা বলছে, নাভারোর মন্তব্য হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে মোদির পররাষ্ট্রনীতি ক্রমশ বিতর্কিত হয়ে উঠছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ভবিষ্যতে প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও দুই দেশ কৌশলগত অংশীদার হিসেবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল, তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক ইস্যুতে অবস্থানগত ফারাক সম্পর্ককে জটিল করছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর চাপ বাড়াতে চাইছে, আবার ভারতও তার স্বাধীন কূটনৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে আগ্রহী।
নাভারোর মন্তব্য নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। বিবিসি, ইন্ডিয়া টুডে ও টাইমস অব ইন্ডিয়া এ বিষয়ে আলাদা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এসব প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, নাভারোর বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক বিতর্কই নয়, ভারতীয় জনগণের জন্যও অপমানজনক হতে পারে। বিশেষ করে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে তার মন্তব্যকে অনেকেই সরাসরি সম্প্রদায়বিদ্বেষী মন্তব্য হিসেবে দেখছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, নাভারোর এই মন্তব্য ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে কতটা প্রভাবিত করবে। যদিও ওয়াশিংটন আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, তবে ধারণা করা হচ্ছে, বাইডেন প্রশাসন নাভারোর বক্তব্য থেকে নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করবে। অন্যদিকে ভারতের পক্ষ থেকেও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে রাজনৈতিক মহল মনে করছে, দিল্লি খুব শিগগিরই এ বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করতে বাধ্য হবে।
সর্বোপরি, পিটার নাভারোর আক্রমণাত্মক মন্তব্য আবারও প্রমাণ করল যে আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে ভারতকে ঘিরে বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু ইউরোপকেন্দ্রিক সংকট নয়, এটি এশিয়াতেও প্রভাব ফেলছে। আর সেই প্রভাবের কেন্দ্রে এখন ভারত ও তার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
repoter

