ছবি: ছবি: সংগৃহীত
৫ আগস্ট ২০২৫, মঙ্গলবার — স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার পতনের প্রথম বার্ষিকীতে রাজধানীর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিকাল ৫টায় ঐতিহাসিক এ ঘোষণাপত্র পাঠ শুরু করেন তিনি। ঘোষণাপত্রে দেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, দুঃশাসনের পরিণতি ও নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের অভিপ্রায় তুলে ধরা হয়।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, তা ছিল এই ভূখণ্ডে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের অঙ্গীকার। তবে স্বাধীনতার পরপরই সেই আকাঙ্ক্ষা ব্যাহত হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানের কাঠামোগত দুর্বলতা এবং একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, বাকশাল কায়েম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ—এসব ঘটনায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে।
৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান এবং ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে আবারও বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ খুলে গেলেও, ২০০৭ সালের ১/১১ পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন পোক্ত হতে থাকে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানকে অগণতান্ত্রিকভাবে পরিবর্তন করে, একদলীয় আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করে। এই শাসনের অধীনে বিরোধী কণ্ঠ দমন, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের অভিযোগ উঠে।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, গত ১৬ বছরে দেশজুড়ে শাসক দলের সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার এবং পরিবেশ ও জলবায়ু ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে জনগণের ক্ষোভ তীব্রতর হয়। বিশেষ করে তরুণদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের মুখে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সেই গণআন্দোলনে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয় এবং শাসক গোষ্ঠীর নিপীড়নে বহু মানুষ প্রাণ হারায়, আহত ও পঙ্গু হয়।
ঘোষণাপত্র অনুসারে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, ঢাকামুখী লংমার্চ এবং গণভবনমুখী জনতার যাত্রার মুখে শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হন। এরপর, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়।
এই সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের ফলাফলকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া, শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করা এবং গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা। একইসাথে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী নতুন জাতীয় সংসদ গঠন ও গণতান্ত্রিক সংস্কার বাস্তবায়ন করাও এই সরকারের অঙ্গীকার।
ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণ যে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার সূচনা করেছে, তার ধারাবাহিকতায় ফ্যাসিবাদ, দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেই সমাজ হবে ন্যায়বিচারভিত্তিক, পরিবেশ-জলবায়ু সহিষ্ণু এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সবশেষে, ঘোষণাপত্রে এই দাবিও জানানো হয় যে, ২০২৪ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের অধীনে গৃহীত সংবিধানের তফসিলে এটি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এভাবেই ‘জুলাই বিপ্লব’ হয়ে উঠবে একটি নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তিপ্রস্তর।
repoter




