ছবি: -সংগৃহীত ছবি
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নাসের হাসপাতালে ইসরায়েলের বিমান হামলায় অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। সোমবারের এই হামলায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন চারজন সাংবাদিক এবং একজন উদ্ধারকর্মী। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামলার সময় নিহতরা হাসপাতালের চতুর্থ তলায় অবস্থান করছিলেন।
নিহত চার সাংবাদিকের মধ্যে রয়েছেন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের ক্যামেরাম্যান ও চুক্তিভিত্তিক কর্মী হুসাম আল-মাসরি, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসসহ (এপি) একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে কাজ করা মারিয়াম আবু দাগ্গা, কাতারভিত্তিক আল জাজিরার চিত্রগ্রাহক মোহাম্মদ সালামা এবং স্বাধীন সাংবাদিক মোয়াজ আবু তাহা।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, হামলাটি ছিল ডাবল-ট্যাপ কৌশলে পরিচালিত। প্রথমে একটি মিসাইল নিক্ষেপের পর কিছু সময় বিরতি দিয়ে দ্বিতীয়বার হামলা চালানো হয়। দ্বিতীয় হামলার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক, উদ্ধারকর্মী এবং স্থানীয় লোকজন, যারা প্রথম বিস্ফোরণের পর আহতদের উদ্ধার করতে এগিয়ে এসেছিলেন। ফলে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়।
রয়টার্স জানিয়েছে, প্রথম হামলায় তাদের চুক্তিভিত্তিক ক্যামেরাম্যান হুসাম আল-মাসরি নিহত হন। কিছু সময় পর দ্বিতীয় হামলায় আহত হন রয়টার্সেরই আরেক চুক্তিভিত্তিক ফটোসাংবাদিক হাতেম খালেদ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের শব্দ শোনার পর হাসপাতালের ভেতরে ও বাইরে মানুষজন আতঙ্কে ছুটোছুটি শুরু করে। উদ্ধারকর্মী এবং সাংবাদিকরা আহতদের বহন করে নিরাপদ স্থানে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, এমন সময় দ্বিতীয় বিস্ফোরণ ঘটে।
রয়টার্সের সরাসরি সম্প্রচারের ফুটেজে দেখা যায়, হামলার সময় হুসাম আল-মাসরি লাইভ রিপোর্টিং করছিলেন। হঠাৎ করে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায় এবং এর কিছুক্ষণ পর তার নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত হয়।
আল জাজিরার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নিহতদের একজন তাদের নিজস্ব চিত্রগ্রাহক মোহাম্মদ সালামা। সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, “আল জাজিরার ক্যামেরাম্যান মোহাম্মদ সালামাসহ আরও তিনজন সাংবাদিক এই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। অব্যাহত হামলার পরও গত ২৩ মাস ধরে আল জাজিরা গাজায় চলমান ইসরায়েলি অভিযানের খবর বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরছে।”
রয়টার্সও তাদের বিবৃতিতে শোক প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, “নাসের হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলায় আমাদের চুক্তিভিত্তিক ক্যামেরাম্যান হুসাম আল-মাসরি নিহত হয়েছেন এবং ফটোসাংবাদিক হাতেম খালেদ গুরুতর আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত।” তারা আরও জানিয়েছে, আহত হাতেম খালেদের জন্য জরুরি চিকিৎসা সহায়তার ব্যবস্থা করতে গাজা ও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
হামলার বিষয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে হামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই মনে করছেন, সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে যাতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে স্বাধীন সংবাদ প্রচার বাধাগ্রস্ত হয়।
ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সমিতি এ হামলার নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছে, “এটি স্বাধীন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা। সাংবাদিকদের হত্যা করে বিশ্ববাসীর সামনে ইসরায়েলি অপরাধ তুলে ধরতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান যুদ্ধে এখন পর্যন্ত গাজায় ২৪০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, এটি আধুনিক ইতিহাসে সাংবাদিকদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।
নাসের হাসপাতালে চালানো এই হামলা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে যে, গাজায় মানবিক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। যুদ্ধ চলাকালে হাসপাতাল ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্যবস্তু বানানো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের শামিল। কিন্তু গাজার সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক, রোগী এবং সাংবাদিকেরা বারবার এমন হামলার শিকার হচ্ছেন।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দ্বিতীয় হামলার পর হাসপাতালের চতুর্থ তলায় অগ্নিকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে। আহতদের অনেককেই অচেতন অবস্থায় ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়। এক উদ্ধারকর্মীও ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আহতদের কক্সবাজারের সীমিত চিকিৎসা সুবিধার মধ্যে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়নি। অনেককে পাশের ছোট ক্লিনিকে নেওয়া হয়, কিন্তু পর্যাপ্ত ওষুধ এবং যন্ত্রপাতির অভাবে চিকিৎসকরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া এখনো স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়নি। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ঘটনায় তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজার বর্তমান পরিস্থিতি শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংঘাত নয়, এটি মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। হাসপাতাল, স্কুল এবং শরণার্থী শিবিরে হামলা চালিয়ে বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য বড় ধরনের নৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
নাসের হাসপাতালের এই মর্মান্তিক হামলা গাজায় চলমান যুদ্ধের ভয়াবহ বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। নিহত সাংবাদিকদের পরিবার এবং সহকর্মীরা শোকাহত হলেও তারা বলছেন, সত্য তুলে ধরার কাজ তারা চালিয়ে যাবেন।
repoter

