ছবি: -সংগৃহীত ছবি
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা বহিরাগতদের হামলার প্রতিবাদে এবং নিজেদের ছয় দফা দাবির পক্ষে রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলনে নেমেছেন। তাদের এ কর্মসূচির কারণে সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) বিকেল থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে সব ধরনের ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
বিকেল চারটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুল জব্বার মোড় সংলগ্ন রেললাইনে শিক্ষার্থীরা সারিবদ্ধভাবে বসে পড়েন। হাতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড নিয়ে তারা স্লোগান দিতে থাকেন এবং ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের শপথ ব্যক্ত করেন। আন্দোলনকারীদের দাবি, বহিরাগতরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করতে হামলা চালিয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই ঘটনায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ক্যাম্পাস ও হল বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। শিক্ষার্থীদের মতে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্রশাসনের ব্যর্থতা ও উদাসীনতার প্রমাণ।
শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের ছয় দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। তারা বলেন, “আমরা ক্যাম্পাসে নিরাপদে পড়াশোনা করতে চাই। বহিরাগতদের হামলা শুধু আমাদের শারীরিক ক্ষতি করেনি, আমাদের নিরাপত্তার প্রতি এক গভীর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। আমরা প্রশাসনের এমন ভূমিকা মেনে নিতে পারি না।”
গত ৩০ আগস্ট রাত পোনে ৮টার দিকে ক্যাম্পাস এলাকায় বহিরাগতরা আকস্মিক হামলা চালায়। এ সময় সাংবাদিক ও নারী শিক্ষার্থীসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। আহতদের স্থানীয় হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। ঘটনার পর থেকেই ক্যাম্পাসে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীরা রাত থেকেই বিক্ষোভ শুরু করে এবং পরদিন ক্যাম্পাসে নানা কর্মসূচি পালন করে।
ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনও শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাকৃবি শাখা ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা বিবৃতি দিয়ে এ হামলার কঠোর প্রতিবাদ জানান। তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায়ী করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
তবে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে প্রশাসনের সিদ্ধান্ত। হামলার ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। শিক্ষার্থীরা এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “অপরাধীরা বহিরাগত। অথচ শাস্তি পেলাম আমরা। এই সিদ্ধান্ত শুধু অন্যায় নয়, আমাদের অধিকার হরণের সামিল।”
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের ছয় দফা দাবির মধ্যে রয়েছে— বহিরাগতদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তি নিশ্চিত করা, হামলার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করা, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং শিক্ষার্থীদের মতামত ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া।
শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচির কারণে ঢাকাগামী ও ময়মনসিংহগামী যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। দীর্ঘ লাইনে আটকে থাকা ট্রেনগুলোতে যাত্রীরা দুর্ভোগ পোহান। অনেক যাত্রী বাধ্য হয়ে অন্য যানবাহনে যাত্রা শুরু করেন। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ট্রেন চলাচল স্থগিত রাখা হবে।
ক্যাম্পাসের ভেতরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানালেও শিক্ষার্থীরা পুলিশের উপস্থিতিকে যথেষ্ট মনে করছেন না। তাদের অভিযোগ, হামলার রাতে পুলিশ যথাসময়ে হস্তক্ষেপ করলে এমন ঘটনা ঘটত না।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা চাই না কোনো শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হোক। তবে পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় ক্যাম্পাস ও হল সাময়িকভাবে বন্ধ করা ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।” তিনি আশা প্রকাশ করেন, আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা জোর দিয়ে বলছেন, আলোচনার কোনো সুযোগ নেই যতক্ষণ না তাদের দাবি পূরণ হচ্ছে। তারা বলেন, “আমাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ। আমরা শুধু চাই প্রশাসন ও সরকার আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক। বহিরাগতদের হাতে মার খেয়ে আমরা নীরব থাকতে পারি না।”
ঘটনার প্রেক্ষিতে স্থানীয় রাজনৈতিক মহলও সরব হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহিরাগতদের প্রবেশ ও প্রভাব দীর্ঘদিনের সমস্যা। এর সমাধান না হলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অব্যাহত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। শিক্ষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে শিক্ষার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন।
পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে শিক্ষার্থীরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তাদের ছয় দফা বাস্তবায়ন ছাড়া আন্দোলন থামানো হবে না। আর এই অনড় অবস্থানের কারণে রেলপথ অবরোধের মতো কর্মসূচি আরও বিস্তৃত আকার নিতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নতুন কিছু নয়। তবে এবার বহিরাগতদের হামলাকে কেন্দ্র করে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে জাতীয় আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি এটি আবারও দেখিয়ে দিল, শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার রক্ষায় কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
repoter




