
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৪০ কোটি রোমান ক্যাথলিকের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন মার্কিন-পেরুভিয়ান ধর্মযাজক রবার্ট ফ্রান্সিস প্রেভোস্ট। নতুন পোপ হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন ‘লিও চতুর্দশ’ নাম, যা শুধু এক পরিচয়ের মাধ্যম নয়, বরং ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক বলেই বিবেচিত হচ্ছে।
শুক্রবার (৯ মে) বার্তা সংস্থা রয়টার্স তার পোপ নির্বাচিত হওয়ার খবর নিশ্চিত করে। প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা পূরণে পুরো ক্যাথলিক বিশ্ব অপেক্ষায় ছিল নতুন নেতৃত্বের। কে হবেন উত্তরসূরি, কেমন হবে তার দর্শন—এই প্রশ্নগুলো নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছিল বিশ্বের নানা প্রান্তে। সেই উত্তরের ইঙ্গিত মিলেছে পোপ লিও চতুর্দশের নামগ্রহণ, প্রথম ভাষণ এবং তার পোশাকের মধ্য দিয়ে।
যদিও ‘লিও চতুর্দশ’ নামটি প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয়েছে, এর একটি ঐতিহাসিক দিক রয়েছে। বিশ শতকের সূচনালগ্নে পোপ লিও ত্রয়োদশ ক্যাথলিক চার্চে সামাজিক ন্যায়বিচার, শ্রমিক অধিকার এবং শিক্ষার বিষয়ে বলিষ্ঠ অবস্থানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। নতুন পোপ তার নামের ধারাবাহিকতায় যে বার্তা দিতে চেয়েছেন, তা বিশ্লেষকদের চোখ এড়ায়নি। তাদের মতে, লিও চতুর্দশ বোঝাতে চেয়েছেন যে তিনি চার্চের ঐতিহ্য ও সামাজিক দায়িত্ববোধকে গুরুত্ব দিয়ে পথ চলতে চান।
বিশিষ্ট যাজক ও ধর্ম বিশ্লেষক থমাস রীস মন্তব্য করেছেন, এই নাম গ্রহণ নতুন পোপের পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট ঘোষণাস্বরূপ—তিনি শুধু আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে নয়, সামাজিক প্রশ্নগুলোতেও সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চান।
ভ্যাটিকানের সেইন্ট পিটার্স স্কয়ারে উপস্থিত হাজারো মানুষ এবং বিশ্বজুড়ে টেলিভিশন ও অনলাইনের সামনে বসে থাকা কোটি কোটি দর্শকের উদ্দেশ্যে তার প্রথম ভাষণটি ছিল শান্তিপূর্ণ ও সংযত। ভাষণের মূল অংশ ছিল ইতালীয় ভাষায়, তবে নিজের পেরুভিয়ান শিকড়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু অংশে স্প্যানিশও ব্যবহার করেন তিনি। ইংরেজি ভাষা এড়িয়ে যাওয়াকে কেউ কেউ দেখছেন আঞ্চলিক সংস্কৃতির প্রতি একধরনের আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে, আবার অনেকে একে একটি নতুন রীতির সূচনা বলেও মনে করছেন।
পোপ লিও চতুর্দশ ভাষণে বলেন, “স্রষ্টার শান্তি হোক আমাদের সকলের মাঝে—একটি নম্র, গভীর এবং স্থায়ী শান্তি।” প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসের স্মরণে তিনি বলেন, “তার সাহসী অথচ কোমল কণ্ঠ এখনো আমাদের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়।” ভাষণ শেষে তিনি প্রয়াত ফ্রান্সিসের সর্বশেষ আশীর্বাদবাণীই ব্যবহার করেন, যা ছিল একটি দৃঢ় ঐক্যের প্রতীকী বার্তা।
নতুন পোপের পোশাকেও প্রতিফলিত হয়েছে তার দৃষ্টিভঙ্গি। যেখানে পোপ ফ্রান্সিস ২০১৩ সালে পোপ হওয়ার সময় ঐতিহ্য ভেঙে সাধারণ ও সরল পোশাক বেছে নিয়েছিলেন, সেখানে লিও চতুর্দশ ফিরেছেন ঐতিহ্যের গাম্ভীর্যে। তিনি পরেছেন রক্তিম প্যাপাল ক্লোক ও সাদা রোবে, যা ইতিহাস ও প্রথার প্রতি তার শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি একটি স্পষ্ট বার্তা—তিনি চার্চের ইতিহাস ও প্রথা রক্ষার মাধ্যমেই চার্চকে এগিয়ে নিতে চান।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পেরুর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে বেড়ে ওঠা রবার্ট প্রেভোস্ট একজন অভিজ্ঞ যাজক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা, ধর্মপ্রচার এবং সমাজসেবার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পোপ হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি শুধু নিজেকে নয়, বরং পুরো ক্যাথলিক চার্চকে নতুন এক দায়িত্বশীলতার পথে পরিচালিত করার প্রত্যাশা জাগিয়েছেন।
পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যিনি দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ‘গরিবের পোপ’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। এখন নতুন পোপ লিও চতুর্দশ কীভাবে সেই মানবিক ঐতিহ্যকে ধারণ করবেন, সেটিই দেখার বিষয়।
তার নাম, ভাষণ ও পোশাক একত্রে বলছে—লিও চতুর্দশ একটি স্থিতিশীল, ন্যায়ভিত্তিক ও ঐতিহ্যসম্মত চার্চ গঠনের প্রত্যয়ে যাত্রা শুরু করেছেন। আর তার এই নেতৃত্ব ভবিষ্যতের ক্যাথলিক চার্চের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করছেন বিশ্লেষকরা।
repoter