
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে প্রকাশ, লন্ডনের সম্পদ বিক্রি ও হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় জড়িত শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে ও ভাতিজার লন্ডনের প্রায় ১ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করে। এর পর থেকেই আলোচনায় আসে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তির যুক্তরাজ্যে অবস্থিত সম্পদের বিষয়ে, যেগুলোর ওপর বর্তমানে বাংলাদেশে তদন্ত চলমান থাকলেও লন্ডনে সেসব সম্পদের লেনদেন অব্যাহত রয়েছে।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, শেখ হাসিনার সরকারের সময় বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনকারী কিছু ব্যক্তি এবং তাঁদের আত্মীয়রা গত বছর থেকে যুক্তরাজ্যে তাদের সম্পদ বিক্রি, বন্ধক কিংবা হস্তান্তর করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের জমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানের তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে এমন অন্তত ২০টি লেনদেনের আবেদন জমা পড়েছে। এই নথিগুলো সাধারণত সম্পত্তি বিক্রি, হস্তান্তর বা বন্ধকের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে জানা যায়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান শাহ আলমের পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন তিনটি সম্পদ সম্প্রতি লেনদেনের আওতায় এসেছে। এর মধ্যে একটি লন্ডনের অভিজাত নাইটসব্রিজ এলাকায় অবস্থিত একটি চারতলা টাউনহাউস, যেটি সাম্প্রতিক সময়ে দুইবার লেনদেন হয়েছে। বাড়িটির উদ্দেশ্য স্পষ্ট না হলেও এটি আগে সরাসরি বসুন্ধরার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের নামে ছিল। বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সোবহান পরিবারকে কেন্দ্র করে একটি তদন্ত পরিচালনা করছে।
এছাড়াও, সারে’র ভার্জিনিয়া ওয়াটারে অবস্থিত প্রায় ১৩০ কোটি টাকা মূল্যের একটি ম্যানসনের মালিকানাসহ আরও দুটি সম্পদের লেনদেনের আবেদন জমা পড়েছে, যা সোবহান পরিবারের আরেক সদস্যের নামে। গার্ডিয়ানের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সোবহান পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে পূর্বে পরিবারটির পক্ষ থেকে সব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
দুদকের তদন্তের আওতায় এসেছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের আরও দুই সদস্য—তার ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী এবং একজন সফল ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। যদিও ওই ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করা হয়নি, তবে জানা গেছে, তারা গত এক বছরে যুক্তরাজ্যে একাধিক সম্পত্তি লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আনিসুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন চারটি সম্পত্তি বাজারে তোলা হয়েছে। তার মধ্যে রিজেন্টস পার্ক সংলগ্ন একটি জর্জিয়ান টাউনহাউস ২০২৩ সালের জুলাইয়ে বিক্রি হয়, যার মূল্য আনুমানিক ১৬৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া আরও তিনটি সম্পদের লেনদেনের জন্য আবেদন জমা পড়েছে।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, আনিসুজ্জামানের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে কোনো বৈধ অভিযোগ বা সম্পদ জব্দের যৌক্তিকতা নেই। তবে মে মাসে এনসিএ তাঁর কিছু সম্পত্তি জব্দ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে লন্ডনের মেফেয়ারে অবস্থিত একটি অ্যাপার্টমেন্ট, যার মূল্য প্রায় ৫৭১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান দুদককে অনুরোধ করেছিলেন যাতে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর লন্ডনভিত্তিক এক ডেভেলপারকে অনিয়মিত ঋণ সুবিধা প্রদানে ভূমিকা ছিল কি না তা তদন্ত করা হয়। বর্তমানে ওই ডেভেলপারের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
এছাড়াও, যুক্তরাজ্যের জমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানে তিনটি লেনদেনের আবেদন জমা পড়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান এফ রহমান ও ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের মালিকানাধীন সম্পত্তি নিয়ে। এনসিএ মে মাসে তাদের মালিকানাধীন মেফেয়ারের একটি অ্যাপার্টমেন্টসহ মূল্যবান সম্পদ জব্দ করে। তাদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত এখনো চলমান রয়েছে।
সালমান এফ রহমান পরিবারের আইনজীবীরা দাবি করেছেন, তাদের মক্কেলদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তারা যুক্তরাজ্যে যে কোনো তদন্তে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দুর্নীতি ও করবিষয়ক পর্যালোচনায় গঠিত সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের সভাপতি এমপি জো পাওয়েল গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, সম্পত্তি জব্দে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে তদন্ত চলাকালীন সময়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সম্পদ স্থানান্তর করে ফেলতে পারেন। এনসিএ যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা স্বাগত জানিয়ে তিনি এসব কার্যক্রমের আরও বিস্তার চান।
উল্লেখ্য, এনসিএ মে মাসে শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের পরিবারের সদস্যদের প্রায় ১ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকার সম্পদ এবং ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রায় ২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করে। অভিযোগ রয়েছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী শেখ হাসিনার শাসনামলে বিপুল সম্পদ গড়েছেন, যার মধ্যে যুক্তরাজ্যেই ৩০০টির বেশি সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে।
repoter