ছবি: -সংগৃহীত ছবি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি জগতে সুপরিচিত নাম ব্রায়ান ও’কেলি। বয়স মাত্র ৪৮, অথচ নিজের জীবনের এক অভিনব ও সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন। ও’কেলি আ্যাপনেক্সাস নামের বিজ্ঞাপন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সহ–প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালে মার্কিন টেলিকম জায়ান্ট এটিঅ্যান্ডটির কাছে বিক্রি হয়। বিক্রির সময় তার শেয়ার ছিল মোট কোম্পানির ১০ শতাংশ, যার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কিন্তু জীবনের এই বিশাল অর্জন নিজের ভোগ-বিলাসে না খরচ করে তিনি নিয়েছেন ভিন্ন এক পথ। নিজের পরিবারের জন্য রাখলেন মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও কম। বাকি পুরো অর্থ দান করে দিলেন বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ, জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম ও মানবতার প্রয়োজনে। তার এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রে শুধু নয়, সারা বিশ্বেই আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ব্রায়ান ও’কেলি বলেছেন, তিনি ও তার স্ত্রী একসাথে ভেবে দেখেছেন জীবনের জন্য আসলে কতটা অর্থ প্রয়োজন। তারা হিসাব করেছেন দৈনন্দিন ও ভবিষ্যতের জন্য আবশ্যক খরচ, তারপর সেই অঙ্ককে দ্বিগুণ করেছেন যেন নিরাপত্তা থাকে। এর বাইরে যে বিপুল সম্পদ ছিল, তা তারা অন্যের কাজে ব্যবহার করার জন্য দান করেছেন।
তার মতে, অত্যধিক সম্পদ মানুষকে সমাজ থেকে আলাদা করে ফেলে। এতে বাস্তবতা হারিয়ে যায় এবং অযথা বিলাসিতা বাড়ে। তিনি মনে করেন, ব্যক্তিগত দ্বীপ, বিলাসবহুল ইয়ট কিংবা অতি ধনী জীবনযাপন মানুষের প্রয়োজন নয়, বরং তা অসহনীয়। তার চোখে সম্পদ তখনই মূল্যবান, যখন তা সমাজের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হয় এবং মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়।
বর্তমানে ও’কেলি পরিচালনা করছেন নতুন একটি প্রতিষ্ঠান, যার নাম স্কোপ৩। এই কোম্পানি সরবরাহ চেইনের মাধ্যমে সৃষ্ট দূষণ নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। তার নতুন উদ্যোগ পরিবেশগত প্রভাব কমানোর দিকে লক্ষ্য রাখছে। তবে তিনি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, নতুন উদ্যোগ থেকে আর কখনোই তিনি বিলিয়নিয়ার হতে চান না।
ও’কেলির মতে, তিনি চান না তার সন্তানরা অতি বিলাসিতার মধ্যে বেড়ে উঠুক। তার ইচ্ছা, সন্তানরা সীমিত জীবনে বড় হোক, মূল্যবোধের শিক্ষা পাক এবং সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে শিখুক। সন্তানদের জন্য রেখে যাওয়া অর্থ তাদের জীবনে নিশ্চয়তা দেবে, কিন্তু অযথা বিলাসিতা নয়।
তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “অত্যধিক অর্থ থাকলে মানুষ বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই অর্থ দিয়ে মানুষ নিজের চারপাশে প্রাচীর তৈরি করে ফেলে। আমি চাই না আমার জীবন বা আমার পরিবারের জীবন এমন হোক। সীমিত জীবনযাপনই আমাদের সৎ ও বাস্তবমুখী রাখে।”
ব্রায়ান ও’কেলি এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি বার্তা দিয়েছেন যে, প্রকৃত সম্পদ কেবল অর্থ নয়। বরং এর সঙ্গে জড়িত জবাবদিহিতা, দায়িত্বশীলতা এবং সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক। তার মতে, অর্থের সীমা থাকা উচিত, আর সেই সীমা অতিক্রম করার পর সেই সম্পদ সমাজের জন্য ব্যয় করাই একজন সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব।
তার উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে বিতর্ক উসকে দিয়েছে। ধনকুবেররা আসলেই কি সমাজের জন্য যথেষ্ট দান করছেন? কোটি কোটি ডলার উপার্জনকারীদের কি সত্যিই বিলাসবহুল জীবনযাপনের বদলে সমাজকল্যাণে অবদান রাখা উচিত নয়? ও’কেলির সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই মনে হয়েছে এক নতুন দৃষ্টান্ত।
তার জীবনের দর্শন স্পষ্ট: “আমরা এক জীবনে কতটুকুই বা ভোগ করতে পারি? যে বাড়তি সম্পদ আমাদের জন্য অপ্রয়োজনীয়, তা সমাজের অন্য মানুষের জন্য অনেক বড় পরিবর্তন আনতে পারে।”
ব্রায়ান ও’কেলি শুধু অর্থ দান করেই থেমে থাকেননি। তিনি সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তার দান করা অর্থ ব্যবহার হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং প্রযুক্তিনির্ভর মানবকল্যাণমূলক কাজের জন্য। তার মতে, দানের আসল মূল্য তখনই যখন তা মানুষের জীবনে সরাসরি পরিবর্তন আনে।
এটিঅ্যান্ডটির কাছে আ্যাপনেক্সাস বিক্রির পর থেকেই তিনি ধীরে ধীরে দূরে সরে গেছেন বিলাসিতার জীবন থেকে। অনেক বড় বাড়ি, দামি গাড়ি কিংবা ব্যক্তিগত জেট কেনার পরিবর্তে তিনি মনোযোগ দিয়েছেন সামাজিক কাজে। তার স্ত্রীও একই মত পোষণ করেন। পরিবারটি বিশ্বাস করে, সীমিত সম্পদ দিয়েও সুখী থাকা যায়, যদি সেই জীবন হয় অর্থপূর্ণ।
ও’কেলির এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে। তার কথায়, “অত্যধিক সম্পদ থাকা মানেই সুখ নয়। সুখ মানে হচ্ছে শান্তি, দায়িত্বশীলতা এবং সমাজের জন্য কিছু করা।” তিনি মনে করেন, তার এই সিদ্ধান্ত হয়তো অন্য ধনীদেরও ভাবতে বাধ্য করবে—অতিরিক্ত অর্থের আসল ব্যবহার কোথায় হওয়া উচিত।
এই উদ্যোক্তার গল্প এক নতুন দিক উন্মোচন করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন, বড় হতে হলে শুধু অর্থের প্রয়োজন নেই, বরং প্রয়োজন নৈতিকতা ও মূল্যবোধের। সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেই প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব। তার ভাষায়, “জীবনের মান নির্ধারণ হয় না সম্পদের আকারে, বরং নির্ধারণ হয় আমরা কিভাবে সেই সম্পদ ব্যবহার করি।”
ব্রায়ান ও’কেলির সিদ্ধান্ত এখন আলোচনায় কারণ এটি শুধু দান নয়, বরং জীবনের এক দর্শন। এমন এক দর্শন যা মনে করিয়ে দেয়—অর্থের সীমা আছে, কিন্তু মানবতার সীমা নেই।
repoter

