ছবি: যমুনা নদীর ওপর দেশের দীর্ঘতম রেলওয়ে সেতু নির্মাণের কাজ শতভাগ সম্পন্ন
বাংলাদেশে যমুনা নদীর ওপর দেশের দীর্ঘতম রেলওয়ে সেতু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু নির্মাণের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ফলে সেতুটি এখন পুরোপুরি দৃশ্যমান। চলতি নভেম্বর মাসের ২৭ অথবা ২৮ তারিখ সেতুর ওপর দিয়ে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুটি উদ্বোধন করা হবে আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেতুর নির্মাণকাজের আওতায় থাকা মিউজিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল হওয়ায় ৫০ কোটি টাকা সরকারের কাছে ফেরত যাচ্ছে।
১৯৯৮ সালে যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকা ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দিলে ট্রেনের গতিসীমা কমিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে ঘণ্টায় মাত্র ২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করে, যা যাত্রীদের ভোগান্তি ও শিডিউল বিপর্যয়ের প্রধান কারণ। এই সমস্যা সমাধানে যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেলসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার।
সেতুর অবকাঠামোটি যমুনা সেতুর ৩০০ মিটার উজানে নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ডুয়েলগেজ লাইনের ডাবল ট্র্যাক ব্যবহার করা হয়েছে, যা ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ায় এখন সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে পারবে।
প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মাসউদুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, “সেতুর সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচলের জন্য আগামী ২৭ বা ২৮ নভেম্বর তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।” তিনি আরও জানান, সেতুর দুই পাশের ১৩ কিলোমিটার রেললাইনের কাজও ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।
এ সেতুটি চালু হলে সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে যাত্রীদের সময় সাশ্রয়। বর্তমানে যমুনা নদী পার হতে একটি ট্রেনের প্রায় ৩০ মিনিট সময় লাগে, যেখানে নতুন রেলসেতু দিয়ে এটি সম্ভব হবে মাত্র ৫ মিনিটে। ফলে যাত্রীদের ভোগান্তি কমে যাবে এবং ট্রেন চলাচল আরও কার্যকর হবে।
প্রকল্পের মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মাহবুব আলম জানিয়েছেন, ভারত থেকে আমদানিকৃত প্রযুক্তিপণ্যে কিছু জটিলতার কারণে সেতুর দুই পাশের স্টেশনে কম্পিউটার ভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা (CBIS) চালু করা যায়নি। ফলে জানুয়ারিতে সেতু চালু হলেও ট্রেনের পূর্ণ গতিসীমা ১২০ কিলোমিটার পেতে দুই মাস সময় লাগবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু প্রকল্পের প্রথম বাজেট ছিল ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। পরে মেয়াদ বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যয় দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৫ লাখ টাকায়। এর মধ্যে ২৭.৬০ শতাংশ দেশীয় অর্থায়ন এবং ৭২.৪০ শতাংশ জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে।
এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে সময়সীমা বাড়ানো হয়। ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়াল মাধ্যমে সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এই সেতুর নির্মাণে আধুনিক স্টিল স্ট্রাকচার ব্যবহার করা হয়েছে। জাপানি দুই প্রতিষ্ঠান ওটিজি এবং আইএইচআই জয়েন্টভেঞ্চার পৃথকভাবে সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম অংশের নির্মাণকাজ করেছে। সেতুর কাঠামো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত হওয়ায় এটি আরও টেকসই হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সেতুটি চালু হলে যাত্রীদের সময় সাশ্রয়ের পাশাপাশি মালবাহী ট্রেনের পারাপার আরও সহজ হবে। যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন উভয়ই দ্রুত গতিতে চলাচল করতে পারবে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সর্বশেষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুর সফল বাস্তবায়ন দেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন যুগের সূচনা করবে। যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের সময় কমানোর পাশাপাশি এটি দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার সংযোগ আরও মজবুত করবে।
repoter