ছবি: নাহিদ ইসলাম। (পুরনো ছবি)
বাংলাদেশের সরকার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে গভীর হতাশা এবং ব্যথা প্রকাশ করেছে। ভারত গত ২৬ নভেম্বর চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার এবং জামিন নাকচের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেয়। এই ঘটনায় ভারত বাংলাদেশ সরকারকে তীব্র সমালোচনা করে, যেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও তাদের ওপর আক্রমণ নিয়ে উত্থিত উদ্বেগের মধ্যে এই গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে।
ভারতের বিবৃতি এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের পর বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর হামলার পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং মন্দিরে আক্রমণ ও অপবিত্রতার ঘটনাও উল্লেখ করা হয়। এরপর ভারত বাংলাদেশের সরকারকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আহ্বান জানিয়েছে।
এই বিবৃতির জবাবে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক কঠোর বিবৃতি দেয়, যেখানে বলা হয়, “ভারতের বিবৃতি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।” বাংলাদেশ সরকার দাবি করে, ভারতের এমন মন্তব্য “সত্যের ভুল উপস্থাপন” এবং দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সঠিক চেতনার পরিপন্থী। সরকার আরও জানায়, বাংলাদেশে সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে শান্তি এবং সহাবস্থান নিশ্চিত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
নাহিদ ইসলামের মন্তব্য: ভারতের ‘অনধিকার চর্চা’
এই প্রসঙ্গে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, “ভারত যদি নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ না করে, তবে তারা অন্যের বিষয়ে মন্তব্য করার অধিকারী নয়। এটি ভারতের এক ধরনের অনধিকার চর্চা।” তিনি দাবি করেন, ভারতের এই ধরনের বক্তব্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং পরিস্থিতি আরও উস্কে দেওয়ার চেষ্টা। তিনি ভারতের কাছে আহ্বান জানান যে, তারা যেন আওয়ামী লীগের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা না অনুসরণ করে।
চিন্ময় দাসের গ্রেফতার: ঘটনাপ্রবাহ
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস, যিনি সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র এবং ইসকনের সাবেক নেতা, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করা হয়। গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে একটি সমাবেশে জাতীয় পতাকার ওপর গেরুয়া রঙের ধর্মীয় পতাকা উত্তোলনের পর এই মামলা দায়ের করা হয়। বিএনপি নেতা ফিরোজ খান রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে এ মামলা দায়ের করেন। এরপর ২৫ নভেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারের পর চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়, এবং ২৬ নভেম্বর আদালতে হাজির করা হলে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়। আদালতের বাইরে তার অনুসারীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই সংঘর্ষের এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, যা ঘটনার তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দেয়।
ভারতের বিবৃতি: সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। তারা জানিয়েছে, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে যৌক্তিক দাবি জানানো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারী সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
ভারত আরও দাবি করেছে, বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিক।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া: রাজনৈতিক সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান
বাংলাদেশ সরকার ভারতের এ ধরনের মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে জানায়, এটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা এবং বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং দেশের জনগণের সংবিধানিক অধিকারকে অবমূল্যায়ন করা। বাংলাদেশ সরকার আরও জানায়, দেশটির বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং কোনো প্রকার সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া কার্যক্রম পরিচালনা করে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আরও জানানো হয়, বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে সদা প্রস্তুত। এক্ষেত্রে তারা গত মাসে শান্তিপূর্ণ দুর্গাপূজা উদযাপনের মাধ্যমে তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতি প্রতিশ্রুতি
বাংলাদেশ সরকার নিশ্চিত করে যে, তারা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সামাজিক শান্তি বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বুধবার চট্টগ্রামে অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং বন্দর নগরীতে নিরাপত্তা জোরদারের উদ্যোগ নিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানায়, বাংলাদেশের জনগণের অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং তারা মনে করে যে, সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করার বিষয়টি দেশের সার্বভৌমত্ব এবং আন্তর্জাতিক সম্মান বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া, বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে যে, তারা ভারতসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী এবং তাদের কাছে একই ধরনের দায়িত্বশীল আচরণের প্রত্যাশা করে।
repoter