
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় ব্যাংকগুলোতে গণপদোন্নতির ঘটনা একটি অভূতপূর্ব পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যেখানে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। এর মধ্যে ৭ হাজার ২১৫ জনই সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি পেয়েছেন, যার ফলে ব্যাংকগুলোর শৃঙ্খলা আরো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই পদোন্নতি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যখন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় এবং ব্যাংকগুলোর জনবল কাঠামো বা অর্গানোগ্রাম ভেঙে ফেলানো হয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ইতিহাসে এ ধরনের পদোন্নতি প্রথমবারের মতো হয়েছে, যেখানে পদ না থাকলেও কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে এই পদোন্নতির ঘটনা ঘটেছে। এই পদোন্নতির ফলে ব্যাংকগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা আরো সংকটাপন্ন হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।
সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি পেয়েছেন উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম), সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম), সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও), প্রিন্সিপাল অফিসার (পিও) এবং সিনিয়র অফিসার (এসও) পদে কর্মকর্তারা। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ১ হাজার ৬৭ জন কর্মকর্তা এসপিও থেকে এজিএম পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এজিএম পদটি হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নির্বাহী পদক্ষেপের প্রথম ধাপ, যেখানে বেতন-ভাতা এবং পদমর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
যদিও কর্মকর্তারা এই পদোন্নতি পাওয়ার ফলে তাদের কর্মপরিবেশে অনেক সুবিধা পেতে পারেন, তবে ব্যাংকগুলোর শৃঙ্খলা এবং পরিচালনায় ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে। ব্যাংকগুলো বর্তমানে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, তার মধ্যে মূলধন এবং সঞ্চিতির ঘাটতি অন্যতম। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ পৌঁছেছে, এবং মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
এমন সময়ে এই পদোন্নতি প্রক্রিয়ার সাথে কিছু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে, তারা অনৈতিকভাবে পদোন্নতি অর্জন করেছেন, এবং অনেকেই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহযোগিতায় ঋণের অবলোপন তৈরি করেছেন। এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ইতিহাসে এই পদোন্নতি প্রক্রিয়া একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে উঠেছে।
সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংক এই পদোন্নতির পথচলা শুরু করেছে, যেখানে সোনালী ব্যাংক ২৩ ডিসেম্বর ২ হাজার ১৯২ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়। পরবর্তী দিন ২৪ ডিসেম্বর অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তারা পদোন্নতির দাবিতে পরিচালকদের ঘেরাও করেন, এবং এর পরবর্তীতে ৩ হাজার ৭৭ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়।
এছাড়া রূপালী ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংকও একই ধরণের পদোন্নতি প্রদান করেছে, যেখানে রূপালী ব্যাংক ১ হাজার ৩৬৮ জন এবং জনতা ব্যাংক ৫৭৮ জনকে পদোন্নতি দেয়। এর ফলে এই চারটি ব্যাংকে মোট প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন।
এদিকে, ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আরো দুর্বল হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে, পদোন্নতি প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জন্য ব্যাংকগুলোকে নতুন কক্ষ এবং চেয়ার-টেবিল ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কর্মকর্তাদের সুবিধা বাড়ানোর সাথে সাথে ব্যাংকগুলোর ব্যয়ও বাড়বে, যা ব্যাংকগুলোর সংকটগ্রস্ত অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরো খারাপ করে তুলবে।
এই পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুধু ব্যাংকগুলোর কর্মী মহলে নয়, সরকারের মধ্যেও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। অনেক কর্মকর্তা মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন এবং দাবি করেছেন যে, তারা বৈষম্যের শিকার। এসব কর্মকর্তাদের মতে, তারা দীর্ঘদিন পদোন্নতিহীন থাকার পর গণপদোন্নতির মাধ্যমে তাদের অধিকার অর্জন করেছেন।
মুসলিম চৌধুরী, সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, বলেছেন যে, কিছু কর্মকর্তা দীর্ঘদিন একই পদে আটকে থাকায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে কর্মস্পৃহা কমে যাচ্ছিল। তিনি আশা করছেন, পদোন্নতি প্রাপ্ত কর্মকর্তারা ব্যাংকের উন্নয়নে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখবেন।
অথচ, গুঞ্জন রয়েছে যে, কিছু পদোন্নতি ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি এবং অনিয়ম ঘটেছে, বিশেষ করে রূপালী ব্যাংকে। অনেক কর্মকর্তা দাবি করেছেন যে, তাদের যোগ্যতা সত্ত্বেও তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়নি, আর কিছু অযোগ্য কর্মকর্তারা দুর্নীতির মাধ্যমে পদোন্নতি পেয়েছেন। এসব অভিযোগ ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের মধ্যে অস্বস্তি এবং ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
সবমিলিয়ে, গণপদোন্নতি ব্যাংকগুলোর জন্য একটি নতুন দ্বন্দ্ব এবং চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। অনেকেই মনে করছেন, এই পদোন্নতি প্রক্রিয়া ব্যাংকগুলোর শৃঙ্খলা এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে আরো ক্ষতিগ্রস্ত করবে, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য বিপদজনক হতে পারে।
repoter