
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
গত এক সপ্তাহে দেশের অন্তত ১১টি জেলার বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। জেলা, উপজেলা থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত এসব সংঘর্ষে দেশি অস্ত্র, হাতবোমা, আগ্নেয়াস্ত্র এবং ককটেল ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিও এবং স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যে এই চিত্র স্পষ্ট হয়েছে।
পুলিশ বলছে, বেশিরভাগ সংঘর্ষ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটছে। তারা দাবি করছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, যার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে লিপ্ত হচ্ছে।
সম্প্রতি শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার বিলাসপুর ইউনিয়নের কাজিয়ারচর গ্রামে সংঘর্ষের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, ফাঁকা ফসলের মাঠে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা দুই পক্ষ বালতিভর্তি ককটেল নিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। অনেকের মাথায় হেলমেট এবং হাতে দেশীয় অস্ত্র। পুলিশের তথ্যমতে, শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে এই এলাকায়।
এ সংঘর্ষের পেছনে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ। বারবার সংঘর্ষ ঘটলেও পরিস্থিতি থামছে না। একইদিনে মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও রংপুরেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে নারীসহ ১৫ জন আহত হয়েছেন। মাদারীপুরে এক ইউপি সদস্য ধারালো অস্ত্রের হামলায় গুরুতর জখম হয়েছেন।
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত ও কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন। এর আগে ৪ এপ্রিল মাদারীপুরের কালকিনিতে আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষে একজনের হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। ৩ এপ্রিল ফরিদপুরের সালথা ও নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, ২ এপ্রিল ভোলার চরফ্যাশন ও হবিগঞ্জের আজমেরীগঞ্জ এবং ১ এপ্রিল সিলেট ও লক্ষ্মীপুরেও সংঘর্ষ, গোলাগুলি, কুপাকুপি ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্যমতে, এসব সংঘর্ষের পেছনে স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা কাজ করছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, "পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে, এমনটা আমি মনে করি না। আধিপত্য নিয়ে অস্থিরতা ছিলো আগেও। সবকিছু একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে, এমন আশা করা ঠিক নয়। সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কিছুটা অস্থিরতা থাকবেই। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।"
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ এ বি এম নাজমুস সাকিব মনে করেন, হঠাৎ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, "এ ধরনের হঠাৎ পরিবর্তনে মানুষ নিজেদের অধিকার বাস্তবায়নের চেষ্টায় আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। অন্যের মতামত গ্রহণের মানসিকতা থাকে না। ফলে সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়ে।"
তার মতে, গণতান্ত্রিক রোডম্যাপ না থাকায় রাজনৈতিক দলগুলো সতর্ক থাকতে পারছে না। একারণেই স্থানীয় স্তরে সহিংসতা বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শাহারিয়া আফরিন বলেন, "নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে সংঘাতের প্রবণতাও বাড়বে।"
তিনি বলেন, "গণতান্ত্রিক কাঠামো না থাকায় সবাই নিজেকে 'রাজা' ভাবছে, ফলে অনেকেই অরাজকতার সাহস পাচ্ছে। আগে একটি দল আধিপত্য করত, বাকিরা নিয়ন্ত্রণে থাকত। এখন সবাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কার্যকর না থাকায় অস্থিরতা বেড়েছে।"
মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতার অভাব, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার ঘাটতির কথাও তিনি তুলে ধরেন।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে সংঘর্ষ ও সহিংসতা আরও ব্যাপক হতে পারে।
অপরাধ বিশ্লেষক সাকিব বলেন, পুলিশ বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছে। ঘন ঘন বদলি ও অভ্যন্তরীণ রদবদলে পুলিশের সোর্স নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর ফলে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে বিলম্ব হচ্ছে।
তিনি মনে করেন, সেনাবাহিনী মাঠে থাকলেও তাদের সংখ্যাও কম এবং জনসাধারণ নিয়ন্ত্রণে অভিজ্ঞতা কম। তাই পুলিশকে দ্রুত সুসংগঠিত এবং মনোবল ফিরিয়ে আনা জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা একমত যে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সংঘর্ষ ও সহিংসতার মাত্রাও বাড়তে পারে। তাই এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
repoter