
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশে এক বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন। ফলাফল ছিল একেবারে ‘সুনামি’—আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং তাদের জোটসঙ্গীরা মোট ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের ঝুলিতে মাত্র সাতটি আসন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেন। নির্বাচনের পর পরই চীন থেকে অভিনন্দন জানানো হয়, যা ছিল একটি বড় কূটনৈতিক পদক্ষেপ। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠান। ওই দিনই ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত গণভবনে গিয়ে তাদের অভিনন্দন বার্তা পৌঁছে দেন।
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের মধ্যে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেই চীন বাংলাদেশের সঙ্গে বড় আকারে ঋণ চুক্তি ও প্রতিশ্রুতির বিষয়ে যুক্ত হয়েছিল। তবে ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি—এই সাড়ে পাঁচ বছরেও চীন ধারাবাহিকভাবে ঋণ প্রতিশ্রুতি, চুক্তি ও অর্থছাড়ে যুক্ত ছিল। এসব চুক্তি প্রধানত যোগাযোগ ও জ্বালানি অবকাঠামো কেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে চীনের কোনো নতুন অবকাঠামো ঋণ প্রতিশ্রুতি কিংবা চুক্তি চোখে পড়েনি। এই পরিবর্তনের পেছনে কি চীনের ধারণা ছিল যে শেখ হাসিনার সরকার শিগগিরই পতন হতে পারে? বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন এমন এক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে যেখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
২০১৯ সালে শেখ হাসিনা চীন সফরে গেলে সেখানে তিস্তা, রোহিঙ্গা ইস্যু, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, এবং অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে ঋণ সহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে সফরের পরবর্তী যৌথ বিবৃতিতে তিস্তা প্রকল্প কিংবা বড় অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। শুধু কয়েকটি সমঝোতা চুক্তি এবং ১৪ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। এ থেকেই চীন হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সরকার দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর চায়না স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. সামসাদ মর্তুজা বলেন, "চীন এখনও 'ওয়েট অ্যান্ড সি' নীতি অনুসরণ করছে। তারা সরাসরি বড় অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করছে না, তবে 'সফট পাওয়ার' দিয়ে তারা সম্পর্ক গভীর করছে।" চীনের বর্তমান নীতি মনে করিয়ে দেয় যে তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং বড় প্রকল্পের চুক্তিতে খুব একটা এগিয়ে যাচ্ছে না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে চীন অন্যান্য দেশের মতো শুধুমাত্র রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই কাজ করে না, বরং তারা বুদ্ধিভিত্তিক কর্মকাণ্ডে আগ্রহী। চীন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপড়েন এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈরিতার বিষযটি খুব সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। এই কারণে চীন শেখ হাসিনার সরকারের ওপর সন্দেহ করতে শুরু করেছিল এবং তাদের সামনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ছিল অস্বচ্ছ।
আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, চীন জানত যে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সূচকগুলো শক্তিশালী নয় এবং সরকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বিত হচ্ছে। এই কারণে চীন নতুন ঋণ চুক্তি বা বিনিয়োগে আগ্রহী ছিল না। তবে ব্যক্তি খাতে তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র ক্রমশ বাড়ছে।
বিসিসিসিআই সেক্রেটারি জেনারেল আল মামুন মৃধা বলেন, "চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভিত্তি মানুষের মধ্যে সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। চীন বাংলাদেশে বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ না করলেও ব্যক্তিগত খাতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিধি বাড়িয়েছে।" চীন জানিয়েছে যে তারা সরকার থেকে সরকার পর্যায়ে বড় কোনো ঋণ চুক্তি করেনি, তবে তাদের অংশগ্রহণ ব্যক্তি খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যে রয়েছে।
চীনের ঋণ চুক্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্র এখন সীমিত হয়ে পড়েছে। ২০১৮ সালের আগে ধারাবাহিকভাবে চীন বড় ঋণ চুক্তি করেছে, তবে ২০২৩ সালের পর থেকে দেশটি আর নতুন কোনো বড় ঋণ প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তাদের মনোযোগ বর্তমানে 'মানুষে মানুষে সম্পর্ক' এবং ব্যক্তিগত খাতে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে বেশি।
চীনের কূটনীতিকরা বলেন, তারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে। যখন তারা বুঝতে পেরেছে যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয় এবং সরকার অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবিলা করতে পারছে না, তখন চীন তাদের বিনিয়োগে সতর্কতা অবলম্বন করেছে।
বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে, চীন বাংলাদেশে জনগণের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করতে আগ্রহী, তবে বড় অবকাঠামো প্রকল্পে তাদের বিনিয়োগ একেবারে কমিয়ে দিয়েছে। চীনের এই নীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তাদের সজাগ দৃষ্টি এবং প্রস্তুতির অংশ বলে মনে হচ্ছে।
repoter