
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার ফলে তা ১১.৩৮% তে পৌঁছেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অনুযায়ী, দেশের মূল্যস্ফীতি অক্টোবর মাসের ১০.৮৭% থেকে নভেম্বরে আরও বাড়ে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩.৮০% ছুঁয়েছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাপক চাপ তৈরি করছে।
গত দুই বছরে শ্রীলংকা এবং পাকিস্তানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে। শ্রীলংকায়, যেটি একসময় এক ধ্বংসাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত ছিল, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক ২.১০% দাঁড়িয়েছে, যা অর্থাৎ পণ্যের দাম কমে গেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি ৪.৯০% নেমে এসেছে, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
শ্রীলংকার গতি ও পাকিস্তানের উন্নতির বিপরীতে, বাংলাদেশের বাজারে দাম বেড়েছে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। বিশেষত, প্রতিবছর মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার ফলে দেশটির সাধারণ মানুষ কঠিন অবস্থায় পড়ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির মূল কারণ হলো সরবরাহের ঘাটতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় অস্থিতিশীলতা।
বর্তমানে দেশে যেভাবে মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, তাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক গত দুই বছর ধরে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করে আসছে এবং সুদহার বাড়িয়ে ১০% পর্যন্ত উঠিয়েছে। তবে, এর ফলস্বরূপ মূল্যস্ফীতি কমেনি বরং বেড়েই চলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু চাহিদা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা নয়, সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগও জরুরি। তারা বলেন, বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে উৎপাদন এবং আমদানি বৃদ্ধি করতে হবে। যদি তা না হয়, তবে আগামী দুই-তিন মাসে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।
বাংলাদেশের একাধিক গবেষণা সংস্থা, যেমন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), সরকারের পদক্ষেপগুলোকে অকার্যকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, ‘সরবরাহের ঘাটতি থেকেই মূল্যস্ফীতির উত্থান। সরকার যদি এই ব্যবস্থার পরিবর্তন না করে, তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’
বাংলাদেশের বাজারে সিন্ডিকেট এবং চাঁদাবাজির কারণেও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি পদক্ষেপ সত্ত্বেও এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। ড. ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কিছু চাঁদাবাজ পালিয়ে গেলেও নতুন চাঁদাবাজরা আবার উপস্থিত হয়েছে। এ ছাড়া বাজার সিন্ডিকেট এখনও টিকে রয়েছে।’
বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সাফল্য আসেনি। একদিকে সরকার আমদানি বাড়াতে চাইলেও তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য নানা পদক্ষেপ নিলেও সেগুলো যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এ মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এখন আমাদের প্রয়োজন সরবরাহ ব্যবস্থা বাড়ানো। বাজারে চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহ কম হওয়ায় পণ্যের দাম কমছে না। সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.৩৭%, যা অক্টোবরের ১০.৪৪% থেকে বেড়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার শহরাঞ্চলে ১৪.৬৩% এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার ৯.৩১% ছিল। গ্রামাঞ্চলে, যেখানে সাধারণত খাদ্যদ্রব্যের দাম বেশি, মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.৫৩%, এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩.৪১%।
এদিকে, গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, যেখানে জনগণের আশা ছিল বাজারে চাঁদাবাজি কমবে এবং দাম কমবে, সেখানে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গেছে। একদিকে পুরনো চাঁদাবাজরা পালিয়ে গেলেও নতুন চাঁদাবাজরা বাজারে এসে দখল করেছে।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন যে, এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তবে আগামী কয়েক মাসে রোজার মাসসহ অন্যান্য সময়ে বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। সরকারকে দ্রুত একটি কার্যকর কৌশল নিতে হবে, যাতে সরবরাহ ব্যবস্থা সঠিকভাবে স্থাপন করা যায় এবং সিন্ডিকেটের আধিপত্য ভাঙা যায়।
বাংলাদেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা জানান, একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদহার বাড়ানো হলেও, অন্যদিকে সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না আসায় দাম নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এটি বিশেষভাবে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
এদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। শ্রীলংকায় যেখানে মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক ২.১০%, পাকিস্তানে ৪.৯০%, সেখানে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ১১.৩৮% দাঁড়িয়েছে।
এভাবে, সরকারকে এখন পরিস্থিতির সামাল দিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি তারা বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য ব্যবস্থা না নেয়, তবে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
repoter