
ছবি: ড. আহসান এইচ মনসুর
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, দেশে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আনতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে। বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) রাতে রাজধানীর একটি হোটেলে ব্র্যাক ইপিএল আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন। সেমিনারে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব্যাংকিং খাতের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। গভর্নর মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স প্রবাহ, এবং এলসি খোলার জটিলতা নিয়েও কথা বলেন।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, "বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতির যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা আগামী জুনের মধ্যে ৭ শতাংশে নামবে বলে আমরা আশাবাদী। তবে, এটি পুরোপুরি সহনীয় পর্যায়ে আনতে, যা ৫ শতাংশের কাছাকাছি হবে, অন্তত এক বছর সময় লাগবে।" এই সময়কালে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকার একসঙ্গে কাজ করবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে।
ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট এবং সম্পদ পর্যালোচনা
গভর্নর উল্লেখ করেন যে দেশের বেশ কিছু ব্যাংক বর্তমানে তারল্য সংকটে ভুগছে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য ব্যাংকগুলোর সম্পদ পর্যালোচনা কার্যক্রম শিগগিরই শুরু করা হবে। তারল্য সংকট ব্যাংকগুলোর ঋণদানের সামর্থ্যকে সীমিত করেছে এবং এর ফলে অর্থনীতির অন্যান্য সেক্টরেও প্রভাব পড়ছে। সম্পদ পর্যালোচনা কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে গভর্নর জানান।
তারল্য সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করতে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে এই সংকট মোকাবিলায় সরকারও সহায়তা করবে বলে গভর্নর মন্তব্য করেন।
এলসি খোলায় জটিলতা নেই
গভর্নর আরও উল্লেখ করেন, দেশে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা নেই। তিনি বলেন, "বর্তমানে আমরা এলসি খোলার ক্ষেত্রে কোনো বড় ধরনের সমস্যা দেখছি না। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এলসি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।" গভর্নরের এই মন্তব্য দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি আনবে বলে মনে করা হচ্ছে, কারণ এলসি খোলার জটিলতা মাঝে মাঝে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে।
গভর্নর জানান, গত চার মাসে প্রবাসী কর্মীরা অতিরিক্ত ৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। প্রবাসীদের পাঠানো এই রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল করতে সহায়তা করছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
দেশের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির বিষয়টি গভর্নর গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, "বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা আশা করছি আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নেমে আসবে। এর পরের অর্থবছরে আমাদের লক্ষ্য থাকবে এটি ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা।" মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ইতোমধ্যে কার্যকর হচ্ছে বলে গভর্নর উল্লেখ করেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি আরও কড়াকড়ি করার পাশাপাশি কিছু সীমিতকরণমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে। মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং সুদের হার সামঞ্জস্য রেখে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। গভর্নর বলেন, "আমাদের লক্ষ্য হলো সুদের হার এবং অর্থের সরবরাহের উপর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ রেখে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো।"
গভর্নর আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থাপনাও উন্নত করা হচ্ছে। দেশের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য সরকার ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে বাজারে সরবরাহ বাড়বে এবং পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আলু-পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আলু ও পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গেও আলোচনা করেন। তিনি বলেন, "গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়, যা আলু ও পেঁয়াজ উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে। উৎপাদন যথাসময়ে না হওয়ায় বাজারে সরবরাহ কমে যায় এবং এর ফলে দাম বেড়ে যায়।" এই পরিস্থিতি সাময়িক বলে তিনি উল্লেখ করেন এবং জানান, নতুন ফসল আসার পর এই সংকট কেটে যাবে।
গভর্নর আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, আগামী মাসগুলোতে আলু ও পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল হবে এবং দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে। তিনি বলেন, "আমরা আশা করছি, চলতি মৌসুমে নতুন ফসল বাজারে আসার পর এই দুই প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম অনেকটাই কমে আসবে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।"
রেমিট্যান্স প্রবাহের ইতিবাচক প্রভাব
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, "গত চার মাসে প্রবাসী কর্মীরা অতিরিক্ত ৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এই অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে সহায়তা করছে।"
রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের মুদ্রার মানও কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। প্রবাসী কর্মীদের অবদানকে গভর্নর অত্যন্ত মূল্যবান বলে উল্লেখ করেন এবং তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মন্তব্য করেন।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে বলেন, "মূল্যস্ফীতি, তারল্য সংকট, এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে আমরা আশাবাদী যে এসব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠে আমরা একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে পারব।"
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে এবং ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও নেবে।"
repoter