
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করেছে। বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানান কুয়েটের জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা বিভাগের কর্মকর্তা শাহাদুজ্জামান শেখ।
সিন্ডিকেটের ৯৩তম সভায় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পূর্বঘোষিত আদেশ বহাল রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই সঙ্গে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনসহ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, যদি কোনো শিক্ষার্থী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে, তবে তাকে আজীবন বহিষ্কার করা হবে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন এবং পাঁচজনকে আটক করা হয়। সংঘর্ষের পর থেকে ক্যাম্পাসজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বুধবার সকাল থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্পাসের ফটকের চারপাশে অবস্থান নেয় এবং সেনাবাহিনীকেও টহল দিতে দেখা যায়। তবে কোনো ক্লাস বা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়, এবং আবাসিক হল ত্যাগ করতেও দেখা যায় কয়েকজনকে।
সিন্ডিকেট সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, হামলায় জড়িত বহিরাগতদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে এবং আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে। এছাড়া, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এদিকে, উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীরা তাকে রাতভর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে অবরুদ্ধ করে রাখে। তবে তিনি পদত্যাগ না করায় শিক্ষার্থীরা তাকে বর্জনের ঘোষণা দেয়। বুধবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে তারা একত্রিত হয়ে এই ঘোষণা দেয়। পরে উপাচার্য মেডিকেল সেন্টার থেকে বেরিয়ে সিন্ডিকেট সভায় অংশ নেন।
শিক্ষার্থীদের দাবি, বর্তমান উপাচার্যের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে না। তারা মনে করেন, তার পদত্যাগ না হলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীরা উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ছাত্রকল্যাণ-বিষয়ক পরিচালককে বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এর জন্য সব বর্ষের শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে আবেদন পাঠানোর পরিকল্পনা করে।
এদিকে, কুয়েটের প্রশাসনিক ভবনসহ সাতটি একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। ছয় দফা দাবিতে তারা সকাল থেকেই বিক্ষোভ শুরু করে এবং দুপুর ১টার মধ্যে দাবি পূরণ না হওয়ায় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. আনিছুর রহমান ভূঞার স্বাক্ষরিত সিন্ডিকেট সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ঘোষিত রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের আদেশটি বহাল থাকবে। এর অর্থ, কুয়েটের শিক্ষার্থীরা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে না। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও রাজনৈতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেউ এই আইন লঙ্ঘন করলে তদন্তসাপেক্ষে চাকরিচ্যুতিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মঙ্গলবারের সংঘর্ষের ঘটনায় বহিরাগতদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে, সংঘর্ষে জড়িত শিক্ষার্থীদের সাময়িক বহিষ্কার করা হবে। প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম এ. হাসেমকে। অন্যান্য সদস্যরা হলেন শহীদ স্মৃতি হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ আবু ইউসুফ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু জাকির মোর্শেদ এবং সহকারী পরিচালক (ছাত্রকল্যাণ) শাহ মুহাম্মদ আজমত উল্লাহ।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের তত্ত্বাবধানে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে।
মঙ্গলবার সংঘর্ষের পর থেকেই ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের একাংশ দাবি করছে, ছাত্রলীগের মতো সংগঠনগুলো গোপনে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। অপরদিকে, ছাত্রদলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতেই এই সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে, কুয়েট প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (নর্থ) মো. নাজমুল হাসান রাজীব জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত সংঘর্ষের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি, তবে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কুয়েটের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে এবং পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
repoter