ছবি: ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকায় অন্যতম ক্রিসেন্ট গ্রুপের কর্ণধার আব্দুল আজিজ। বাংলা চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার হিসেবেও তিনি পরিচিত। জনতা ব্যাংকসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে দীর্ঘ পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি রয়েছেন আইনের আওতার বাইরে।
আদালতের নির্দেশে তার বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও সেটি কার্যকর হয়নি। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পরেও তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছেন। ব্যাংক, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ, এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হলেও তিনি এখনো চলচ্চিত্র অঙ্গনে সক্রিয় হয়ে উঠছেন।
ব্যাংক ও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আব্দুল আজিজ দেশের অন্যতম ‘ভাগ্যবান’ ঋণখেলাপি। দেশের অনেক বড় ঋণখেলাপি জেলে গেছেন বা দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু শীর্ষ তালিকার একজন হওয়া সত্ত্বেও আব্দুল আজিজ সবসময় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাধ্যমে তিনি জনতা ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ আদায় করেছেন। এমনকি চলচ্চিত্র জগতের নায়ক-নায়িকাদের ব্যবহার করে এই ঋণ প্রাপ্তি আরও সহজ করেছেন।
সম্প্রতি আবার চলচ্চিত্র অঙ্গনে সরব হতে দেখা যাচ্ছে আব্দুল আজিজকে। জাজ মাল্টিমিডিয়া প্রযোজিত সিনেমার বিভিন্ন নায়িকাদের সঙ্গে তার আড্ডার ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এর মধ্যে অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়ার সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, “আমরা এখন ছোট না।” অন্যদিকে নুসরাত ফারিয়াও পোস্ট করেছেন একই ছবি এবং আব্দুল আজিজের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচটি কোম্পানির নামে জনতা ব্যাংকের ঋণ রয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের নামে রয়েছে ১ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। এই কোম্পানির কর্ণধার আব্দুল আজিজ। গ্রুপটির অন্যান্য কোম্পানির মধ্যে ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্ট লিমিটেডের নামে ১ হাজার ২৯৬ কোটি, রূপালী কম্পোজিট লিমিটেডের নামে ১ হাজার ২৩৯ কোটি, লেক্সকো লিমিটেডের নামে ৫১৪ কোটি এবং ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ লিমিটেডের নামে ২৩১ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।
২০২০ সালের আগেই এসব ঋণ খেলাপি হয়েছে এবং মন্দ মানের খেলাপি হওয়ায় ঋণের উপর সুদ আরোপ বন্ধ রয়েছে। সুদসহ বর্তমানে এই ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার কোটিরও বেশি। বিপরীতে ব্যাংকের কাছে জামানত হিসেবে জমা রাখা হয়েছে মাত্র ৫৭৭ কোটি টাকার সম্পদ। ভুয়া রফতানি নথি এবং প্রতারণার মাধ্যমে এই ঋণ আদায় করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে।
ক্রিসেন্ট গ্রুপ মূলত চামড়া শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত। এই ব্যবসার যাত্রা শুরু হয়েছিল তাদের পৈত্রিক সূত্রে। তবে ২০১২ সালের পর থেকে তাদের ব্যবসা দ্রুত প্রসার লাভ করে। জনতা ব্যাংক থেকে ২০১৩ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক বছরে তারা হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ভুয়া রফতানি দেখিয়ে প্রণোদনার নামেও সরকারের কোষাগার থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
জাজ মাল্টিমিডিয়ার চলচ্চিত্র ব্যবসা ক্রিসেন্ট গ্রুপের এই ঋণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংক থেকে অর্থপ্রাপ্তি বন্ধ হওয়ার পর থেকে জাজ মাল্টিমিডিয়ার চলচ্চিত্র নির্মাণের গতি কমে আসে। তবে আব্দুল আজিজ এখন নতুন করে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন।
রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ বলেন, “ক্রিসেন্ট গ্রুপের ব্যবসা আমাদের পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত। জনতা ব্যাংকের ঋণের সাথে জাজ মাল্টিমিডিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে, তা আমরা আইনগতভাবে মোকাবেলা করছি।”
২০১৮ সালে জনতা ব্যাংকের পক্ষ থেকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে একটি মামলায় রিমেক্স ফুটওয়্যার ও জাজ মাল্টিমিডিয়ার চেয়ারম্যান হিসেবে আব্দুল আজিজকে প্রধান আসামি করা হয়। তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও এসব মামলায় অভিযুক্ত।
একই বছরে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ তার বিরুদ্ধে ৯১৯ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের মামলা করে। দুর্নীতি দমন কমিশনও প্রায় ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আরও পাঁচটি মামলা দায়ের করে।
যদিও ক্রিসেন্ট গ্রুপের অন্য কর্ণধার এমএ কাদের কারাভোগ করেছেন, আব্দুল আজিজ ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আদালতের শর্ত ভঙ্গ করেও তিনি দেশ-বিদেশে অবাধে চলাফেরা করছেন।
ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিলের চেষ্টা করা হলেও তাতে কোনো সাফল্য আসেনি। জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এম ফজলুর রহমান বলেন, “ক্রিসেন্ট গ্রুপের পক্ষ থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি।”
অন্যদিকে জাজ মাল্টিমিডিয়া আবারও বড় পরিসরে সিনেমা বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন আব্দুল আজিজ।
repoter




