
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য তৈরি করা মহাপরিকল্পনাটি নিয়ে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকায় অনুষ্ঠিত তিনদিনব্যাপী ‘বাংলাদেশ জ্বালানি সমৃদ্ধি-২০৫০ সম্মেলনে’ দ্বিতীয় দিনে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সম্মেলনে বক্তারা মহাপরিকল্পনার পেছনে জাপানি কোম্পানির আর্থিক স্বার্থ এবং এটির কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
জাপান সেন্টার ফর সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোসাইটির (জেএসিএসইএস) প্রকল্প পরিচালক ইউকি তানাবে বলেন, মহাপরিকল্পনাটি বাংলাদেশের জন্য আর্থিকভাবে অলাভজনক। এটি প্যারিস চুক্তি ও জি৭-এর বিভিন্ন অঙ্গীকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং নিট জিরো লক্ষ্যের বিপরীতে যায়। ইউকি দাবি করেন, জাপানের নিজস্ব উদ্বৃত্ত এলএনজি এশিয়ার দেশগুলোর কাছে বিক্রির লক্ষ্যেই এই পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। তিনি বলেন, পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য জাপানি কোম্পানিগুলোর সর্বোচ্চ লাভ নিশ্চিত করা।
তিনি আরও বলেন, পরিকল্পনায় ২০৫০ সালের মধ্যে ১৫ শতাংশ অ্যামোনিয়া এবং হাইড্রোজেন কো-ফায়ারিং ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা নবায়নযোগ্য শক্তির তুলনায় চার গুণ বেশি ব্যয়বহুল। এই প্রস্তাব বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইউকির মতে, উন্নত প্রযুক্তির নামে মিথ্যা এবং ব্যয়বহুল সমাধানের কথা এই পরিকল্পনায় উল্লেখ রয়েছে, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অকার্যকর হতে পারে।
এই প্রসঙ্গে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) প্রধান প্রতিনিধি ইচিগুচি তোমোহাইড বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনা একটি জীবন্ত দলিল। নতুন প্রযুক্তি যখন কার্যকর বলে প্রমাণিত হবে এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হবে, তখন প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনা সংশোধন করা যেতে পারে। তবে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে হাইড্রোজেন এবং অ্যামোনিয়া প্রযুক্তি প্রয়োগ করা ঠিক হবে না।
ইচিগুচি আরও জানান, জাইকা বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেও কাজ করে যাচ্ছে। পরিকল্পনাটি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময়োপযোগী সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে।
এদিকে, অধিবেশনে ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ এশিয়া প্যাসিফিকের সমন্বয়ক বারিশ হাসান চৌধুরীর সভাপতিত্বে কৌশলগত দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্বের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হয়। চীন এবং নেপালের মতো দেশগুলোর বিনিয়োগের ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করা হয়, বিশেষ করে জ্বালানি রূপান্তরে। অয়েল চেইঞ্জ ইন্টারন্যাশনালের (ওসিআই) জাপান ফাইন্যান্স ক্যাম্পেইনার মাকিকো আরিমা অধিবেশনটি পরিচালনা করেন।
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের জ্বালানি রূপান্তরের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে জাপানের সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে বর্তমান পরিকল্পনায় আর্থিক কার্যকারিতা এবং পরিবেশগত দিকগুলো যথাযথভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
অধিবেশনে আরও জানানো হয়, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। তবে এটি বাস্তবায়নের জন্য সঠিক কৌশল এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। বক্তারা বিদ্যুৎ-জ্বালানি মহাপরিকল্পনাটির খসড়া পুনর্বিবেচনার ওপর জোর দেন।
সম্মেলনের আলোচনায় উঠে আসে, বাংলাদেশে ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তরের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। পরিকল্পনাটি যেন দেশের আর্থিক ও পরিবেশগত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং জনগণের কল্যাণে ভূমিকা রাখে, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
সম্মেলনে উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা পরিকল্পনাটি সংশোধন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর জোর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তাদের মতে, দেশের জ্বালানি খাতের উন্নতির জন্য উন্নত প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি।
repoter