ছবি: ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষার দাবিতে সম্প্রতি আন্দোলন জোরালো হয়েছে। বিশেষত চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের নেতৃত্বে এই আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। তবে, এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) এবং সনাতনী জাগরণ জোটের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছেন ইসকন থেকে বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে অবস্থিত পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস একসময় ইসকনের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন। তবে, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে তাকে ইসকন থেকে বহিষ্কার করা হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের কর্মকাণ্ড ইসকনের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তার বিরুদ্ধে সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগও আনা হয়েছিল। যদিও তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ইসকন থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন এবং সংগঠন থেকে তাকে কোনো ধর্মীয় কার্যক্রম বা বিবৃতির অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে, পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ হিসেবে তার দায়িত্ব এখনো বহাল রয়েছে। ইসকনের কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে, তার গুরু শাস্ত্রীয় শিক্ষার ওপর সংগঠনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যা তাকে অধ্যক্ষ পদে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বর্তমানে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। এই জোটটি সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, এবং ক্ষতিপূরণ দাবিসহ আট দফা দাবি আদায়ে কাজ করছে। গত আগস্টে সংগঠনটি বিভিন্ন বিভাগীয় সমাবেশ আয়োজন করেছে, যেখানে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে প্রধান বক্তা হিসেবে দেখা গেছে।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের নেতৃত্বাধীন মিছিল ও সমাবেশগুলোতে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাও দায়ের করা হয়। তাকে গ্রেপ্তার করার পরপরই সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। গত অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামে এক সংঘর্ষের সময় বিএনপি-জামায়াতপন্থি এক আইনজীবী সাইফুল ইসলাম নিহত হন। এই ঘটনা ইসকন ও চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ওপর নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত করে।
ইসকন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড তার ব্যক্তিগত বিষয়। সংগঠন এ বিষয়ে কোনো দায়িত্ব নেবে না। তবে, ইসকন বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম থেকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার এবং ইসকনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে নিন্দা জানানো হয়েছে।
ইসকনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিমলা কুমার ঘোষ জানান, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে নিয়ে বিতর্ক বাড়ায় সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আরও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সনাতনী জাগরণ জোটের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সুমন কুমার রায়ের মতে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি বলেন, “ইসকনকে বিতর্কিত করতে এবং সংখ্যালঘু আন্দোলনকে দমন করতে একটি বিশেষ মহল কাজ করছে। মুসলিম সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ইসকনকে সামনে রেখে একটি দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা চলছে।”
সুপ্রিম কোর্টেও ইসকন নিষিদ্ধ চেয়ে একটি আবেদন করা হয়েছে। এই আবেদনটির শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, ইসকনের নিষিদ্ধ হওয়া সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। একইসঙ্গে তিনি জানান, আইনজীবী হত্যার ঘটনা সরকার গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
ইসকনের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি
ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস বা ইসকন একটি বৈষ্ণব মতবাদ ভিত্তিক হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন। সংগঠনটি সারা বিশ্বে কৃষ্ণভাবনা ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রচারে কাজ করে। যদিও ইসকনকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সংগঠনটি নিজেকে একটি শান্তিপূর্ণ এবং সেবামূলক সংগঠন হিসেবে দাবি করে।
ইসকনের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস বলেন, “আমরা সর্বদা শান্তি, সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ্যের জন্য কাজ করে এসেছি। ইসকন কখনো কোনো উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়নি। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের কর্মকাণ্ডে আমরা লজ্জিত এবং তার বিষয়ে সংগঠনের অবস্থান পরিষ্কার।”
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সুরক্ষা এবং ইসকনের ভবিষ্যৎ ভূমিকা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার এবং সনাতনী জাগরণ জোটের আন্দোলন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে।
repoter