
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন (দ্য কমিশন অব এনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স) তাদের প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আজ শনিবার বিকেল ৫টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গুম সংক্রান্ত এই তদন্ত কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করেন।
কমিশনের প্রতিবেদনে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ১,৬৭৬টি গুমের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কমিশনের সদস্যরা এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করেছেন। কমিশন জানায়, গুমের ঘটনাগুলোর তদন্তে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশনার প্রমাণ মিলেছে। এছাড়াও হাসিনা প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, গুমের ঘটনাগুলো এতটাই সুকৌশলে পরিকল্পিত ছিল যে এসব শনাক্ত করা সহজ নয়। কাজটি এমনভাবে পরিচালনা করা হয়েছে, যাতে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর কর্মপ্রক্রিয়া চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তিনি আরও জানান, বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী নিজেদের মধ্যে ভিকটিম বিনিময় করত এবং ঘটনা বাস্তবায়নে ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করত। এ কারণে গুমের পেছনের পুরো চিত্র উন্মোচন করা জটিল হয়ে পড়েছে।
মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, গুমের শিকার অনেকেই এখনো আতঙ্ক থেকে মুক্তি পাননি। তাদের ওপর যে ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, তার ফলে তারা এখনো চরম ট্রমার মধ্যে রয়েছেন। ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে কমিশন বিষয়গুলো অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করছে। কমিশন প্রধান আরও জানান, এই তদন্তের পরবর্তী ধাপ মার্চ মাসে আরেকটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে কমপক্ষে আরও এক বছর সময় লাগবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রতিবেদন জমাদানের সময় গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস এবং মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং সমাজকল্যাণ ও মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদও উপস্থিত ছিলেন।
গুম তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুমের ঘটনা বাস্তবায়নে জড়িত কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয় ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। তদন্তের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভিকটিমদের গুম করার পদ্ধতি ও কৌশল পরিবর্তনশীল ছিল। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ভিকটিমদের স্থানান্তরের মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করা আরও কঠিন করে তোলা হতো। কমিশন বলছে, এটি একক কোনো সংস্থার কর্মকাণ্ড নয়; বরং একাধিক বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এসব গুম সংঘটিত হয়েছে।
তদন্তের কাজে বাধা প্রসঙ্গে কমিশন প্রধান জানান, প্রাথমিকভাবে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছ থেকে তথ্য পেতে বিলম্বের মুখোমুখি হয়েছে কমিশন। তবে ধীরে ধীরে তারা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রতিবেদনটি জমা দেওয়ার সময় কমিশনের পক্ষ থেকে ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তা এবং মানসিক পুনর্বাসনের ওপর জোর দেওয়া হয়। তারা উল্লেখ করেন, যারা গুমের শিকার হয়েছেন বা ফিরে এসেছেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তদন্তে উঠে আসা অনেক ভুক্তভোগী এখনো সমাজে স্বাভাবিকভাবে বসবাস করতে পারছেন না। তাদের মধ্যে গভীর শঙ্কা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বিরাজ করছে।
কমিশনের সদস্য মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, এই তদন্তের মধ্য দিয়ে গুমের প্রকৃত চিত্র উন্মোচিত হবে বলে আশা করা যায়। তিনি আরও বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের দীর্ঘদিন ধরে চলমান অপেক্ষা এবং নিরব কান্নার অবসান ঘটাতে কমিশন আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।
কমিশনের আরেক সদস্য বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী বলেন, তদন্তের কাজে কমিশন কোনো প্রকার রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করেছে। তবে তিনি জানান, এ ধরনের সংবেদনশীল তদন্তে সময়ের প্রয়োজন। কমিশনের সদস্যরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন যাতে সঠিক তথ্য উদঘাটন করা যায় এবং গুমের পেছনে জড়িতদের দায়ী করা সম্ভব হয়।
প্রতিবেদন জমাদানের পর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এই তদন্ত কমিশনের কাজ একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। গুমের ঘটনার তদন্ত এবং দায়ীদের চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে দেশে ন্যায়বিচারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তিনি কমিশনের কাজকে স্বাগত জানান এবং ভবিষ্যতে আরও সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
গুম সংক্রান্ত এই তদন্ত কমিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশজুড়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক মানবাধিকার সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এই কমিশনের কার্যক্রমের ওপর নজর রাখছে। কমিশনের প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিক্রিয়া আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গুমের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগের ভিত্তিতে কমিশন এই তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে সব তথ্য জনসমক্ষে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আগামী তিন মাসের মধ্যে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছে কমিশন। একইসঙ্গে কমিশন আরও জানায়, ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হবে।
কমিশনের এই অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের পর দেশে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হতে পারে। গুমের ঘটনা এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে সঠিক তথ্য উঠে আসার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
repoter