
ছবি: দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল। ছবি : সংগৃহীত
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল অভিশংসিত হয়েছেন। স্বল্প সময়ের জন্য সামরিক আইন জারির পর দেশটিতে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এর জের ধরে তার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অভিশংসন প্রস্তাব তোলা হয়। শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) এক প্রতিবেদনে আল জাজিরা এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আটদিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো পার্লামেন্টে ইউন সুক ইওলের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব আনা হয়। গোপন ব্যালটের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত এই ভোটে দেশটির ৩০০ সংসদ সদস্য অংশ নেন এবং দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। পার্লামেন্টের বাইরে হাজার হাজার মানুষ এ সময় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ইউন সুক ইওলের দল পিপলস পাওয়ার পার্টি (পিপিপি)-এর কিছু সদস্যসহ মোট ২০৪ জন সংসদ সদস্য তার অভিশংসনের পক্ষে ভোট দেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট অভিশংসিত হওয়ার পর তার নির্বাহী ক্ষমতা স্থগিত হয়ে যায়। তবে আইনি জটিলতার কারণে তিনি পদে বহাল থাকবেন। এ অবস্থায় ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন প্রধানমন্ত্রী হ্যান ডাক-সু।
প্রধানমন্ত্রী হ্যান ডাক-সু প্রেসিডেন্ট অভিশংসনের পরপরই একটি বিবৃতিতে বলেন, “আমি দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাব। রাজনৈতিক অস্থিরতার এই পরিস্থিতিতে সরকারকে স্থিতিশীল রাখতে আমার সমস্ত শক্তি এবং প্রচেষ্টা কাজে লাগাব।”
ভোটের পর এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল বলেন, “যদিও এই মুহূর্তে আমাকে বিরতি নিতে হচ্ছে, তবুও আমার দেশের মানুষের জন্য আমার যাত্রা থেমে থাকবে না। গত আড়াই বছরে আমি যে সমর্থন ও ভালোবাসা পেয়েছি, তা আমার শক্তি হয়ে থাকবে। আমি শেষ পর্যন্ত দেশের কল্যাণের জন্য আমার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।”
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও অস্থির হয়ে ওঠে। অভিশংসন প্রস্তাবের আগে, গত ৩ ডিসেম্বর সামরিক আইন জারি করেছিলেন ইউন সুক ইওল। বিরোধী দল ও সংসদ সদস্যদের তীব্র আপত্তির মুখে প্রেসিডেন্টকে সেই আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হতে হয়। সামরিক আইন জারির পর দেশজুড়ে সমালোচনা এবং বিক্ষোভ শুরু হয়। এরপর দক্ষিণ কোরিয়ার একটি আদালত প্রেসিডেন্ট ইউনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক আইন জারি করে বিরোধীদের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা এবং জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোই ইউন সুক ইওলের অভিশংসনের মূল কারণ। তার এই সিদ্ধান্ত দক্ষিণ কোরিয়ার গণতান্ত্রিক চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
অন্যদিকে, পিপলস পাওয়ার পার্টির (পিপিপি) নেতারা প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলছেন, দেশের নিরাপত্তা এবং সুশাসন বজায় রাখতে তিনি সামরিক আইন জারি করেছিলেন। তবে তাদের এ বক্তব্য বিরোধী দলগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। বিরোধী দলের দাবি, সামরিক আইন জারির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইউন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন।
অভিশংসন ভোটের দিন পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়ে বিক্ষোভ করেন। তারা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার দাবিতে স্লোগান দেন। বিক্ষোভকারীরা বলেন, “গণতন্ত্রের অবমাননা আমরা মেনে নেব না। সামরিক আইন জারি করে জনগণের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ইউনকে অবশ্যই তার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে হবে।”
অভিশংসনের পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী হ্যান ডাক-সু একাধিক বৈঠক করেন এবং সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, “এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। আমরা জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করব।”
দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণের মধ্যে ইউন সুক ইওলের অভিশংসন মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সমর্থন জানালেও অনেকে মনে করছেন, এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ইউনের অভিশংসন দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিমত্তা ও আইনের শাসনকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে অভিশংসনের কারণে রাজনৈতিক বিভাজন আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে, বিরোধী দলগুলো প্রেসিডেন্টের অভিশংসনকে জনগণের বিজয় হিসেবে বর্ণনা করেছে। তাদের মতে, এটি প্রমাণ করে যে দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরশাসন মেনে নেবে না।
এদিকে, সামরিক আইন জারির পর প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওলের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল। অভ্যন্তরীণ জরিপগুলোতেও তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অভিশংসনের পেছনে এই জনরোষও বড় ভূমিকা রেখেছে।
এই অভিশংসনের পর দক্ষিণ কোরিয়ায় পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে জনগণের মন জয় করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অভিশংসনের ফলে দেশটির রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হলেও পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে কিছুটা সময় লাগবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ঘটনার মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে সামরিক আইন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জনগণের শক্ত অবস্থানের বার্তা স্পষ্ট হয়েছে।
repoter