ছবি: ছবি: সংগৃহীত
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে স্বাক্ষরিত বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তিগুলো পুনঃমূল্যায়ন ও পর্যালোচনায় সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক মানের একটি লিগ্যাল ও তদন্তকারী সংস্থা নিয়োগের সুপারিশ করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন এই কমিটি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এ সুপারিশ করেছে।
পর্যালোচনা কমিটি জানিয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিভিন্ন চুক্তির তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের জন্য তাদের আরো সময় প্রয়োজন। কমিটি এমন সব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছে, যা আন্তর্জাতিক সালিশি আইন এবং কার্যধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চুক্তিগুলো পুনর্বিবেচনা বা বাতিলের জন্য কার্যকর হতে পারে। তারা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে, তদন্ত ও পর্যালোচনার কাজ আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে হবে এবং এ ধরনের কাজ আন্তর্জাতিক সালিশে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি ইতোমধ্যেই সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পর্যালোচনার কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- আদানি পাওয়ারের গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র – ১,৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
- পটুয়াখালীর পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র – ১,৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র।
- নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র – ৩৩৫ মেগাওয়াট ডুয়াল ফুয়েল কেন্দ্র।
- আশুগঞ্জ গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্র – ১৯৫ মেগাওয়াট।
- বাঁশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র – ৬১২ মেগাওয়াট।
- সামিট গ্রুপের মেঘনাঘাট কেন্দ্র – ৫৮৩ মেগাওয়াট ডুয়াল ফুয়েল কেন্দ্র।
- ইউনিক গ্রুপের মেঘনাঘাট কেন্দ্র – ৫৮৪ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক (এলএনজি)।
বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ২০১০ সালে 'বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন' প্রণয়ন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। বিশেষ এই আইনের অধীনে প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিদ্যুৎ, জ্বালানি কেনা ও অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হয়। এমনকি এই আইন আদালতে চ্যালেঞ্জ করারও সুযোগ রাখেনি। এটি "দায়মুক্তি আইন" হিসেবে সমালোচিত হয় এবং অভিযোগ ওঠে, সরকারের পক্ষ থেকে একচেটিয়া সুবিধা দিয়ে বিপুল অর্থ পাচার করা হয়েছে।
বিপিডিবি’র তথ্য অনুযায়ী, এই আইনের অধীনে ৯১টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতা ১১,৭০০ মেগাওয়াট। অনেক কেন্দ্র অচল অবস্থায় রেখেও ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে এই বিশেষ আইন স্থগিত করেছে এবং বেশ কিছু চুক্তি বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে। হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি বিদ্যমান চুক্তিগুলোর স্বচ্ছতা, কার্যকারিতা ও রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় পুনর্বিবেচনার কাজ শুরু করেছে।
পর্যালোচনা কমিটি উল্লেখ করেছে, বিদ্যুৎ চুক্তিগুলো পুনর্বিবেচনার জন্য আন্তর্জাতিক লিগ্যাল এবং তদন্ত সংস্থা নিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। এ সংস্থাগুলো চুক্তির আন্তর্জাতিক বৈধতা, সালিশি প্রক্রিয়ায় গ্রহণযোগ্যতা এবং দেশের স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশেষ আলোচনায় এসেছে ভারতের ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত আদানি গ্রুপের ১,৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র। চুক্তি অনুযায়ী, ২৫ বছরের মেয়াদে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ কিনবে। অভিযোগ রয়েছে, চাহিদা না থাকলেও বিপিডিবিকে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য করা হয়েছে
দেশের প্রথম আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণেও রয়েছে বিতর্ক। চীন ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত এ প্রকল্পে খরচ হয়েছে ১৯ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। তবে এর কার্যকারিতা ও ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
কমিটি তাদের কার্যপরিধির আওতায় যেকোনো তথ্য বা নথি সংগ্রহ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শুনানিতে আহ্বান করতে পারে। পর্যালোচনার ভিত্তিতে সরকারকে সুপারিশ প্রণয়ন করে দেবে কমিটি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় তাদের আনুষঙ্গিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ চুক্তিগুলোতে সরকারের স্বার্থ সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে এই পর্যালোচনার উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক লিগ্যাল ও তদন্ত সংস্থা নিয়োগে পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে বিদ্যুৎ খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
repoter