ছবি: প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করছে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি | ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি, লুণ্ঠন, এবং আর্থিক কারচুপির ভয়ংকর চিত্র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
আজ রোববার (১ ডিসেম্বর) কমিটির প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নেতৃত্বে কমিটির সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে এটি হস্তান্তর করেন।
দুর্নীতি ও লুটপাটে ভরপুর শাসনামল
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে লুণ্ঠন ও চামচা পুঁজিবাদের (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াই আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করেছি এবং দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেছি।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত শাসনামলে ২৯টি বৃহৎ প্রকল্পে ৮৭ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৭ লাখ ৮০ কোটি টাকা) ব্যয় হয়েছে। পরীক্ষিত সাতটি প্রকল্পে প্রাথমিক বাজেট ছিল ১ লাখ ১৪ কোটি টাকা, যা নানা অনিয়মের মাধ্যমে ১ লাখ ৯৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
কমিটির সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “প্রকল্পগুলোতে অতিরিক্ত উপাদান যোগ করে এবং জমির দাম বাড়িয়ে ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর পেছনে আর্থিক কারচুপির বড় প্রভাব রয়েছে।”
অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির বিস্তৃত চিত্র
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ব্যয়িত ৭ লাখ কোটি টাকার ৪০ শতাংশ আমলারা লুটপাট করেছেন। কমিটির সদস্য অধ্যাপক এ কে এনামুল হক জানান, “শাসনামলের লুটপাট ও দুর্নীতির পরিমাণ জাতীয় অর্থনীতির ওপর বিশাল প্রভাব ফেলেছে। কর অব্যাহতির ফলে জিডিপির ৬ শতাংশের সমপরিমাণ রাজস্ব হারিয়েছে দেশ, যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বহুগুণ বরাদ্দ দিতে পারত।”
বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের অসঙ্গতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কমিটির সদস্য এম তামিম বলেন, “বিদ্যুৎ খাতে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। এর কমপক্ষে ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৩ বিলিয়ন ডলার অবৈধ লেনদেন হয়েছে বলে আমাদের প্রাথমিক অনুমান।”
নিরাপত্তাহীনতায় অর্থনীতি ও প্রশাসনিক দ্বন্দ্ব
ড. ইউনূস শ্বেতপত্রকে একটি “ঐতিহাসিক দলিল” বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “গরিব মানুষের রক্ত পানি করা টাকা যেভাবে লুটপাট হয়েছে তা আতঙ্কিত করার মতো। এই চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরা উচিত এবং এটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের শেখানো দরকার।”
তিনি আরও বলেন, “বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোও এই লুটপাটের বিরুদ্ধে নীরব ছিল। কারণ, শাসনামলের ভয়ের রাজত্ব তাদের কার্যক্রম সীমিত করে দেয়।”
কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, “অর্থ পাচারের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা উচিত। বিচার প্রক্রিয়া শুরু না করলে এসব দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের পুনরাবৃত্তি হবে।”
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদন শুধু অর্থনৈতিক লুটপাট ও পাচারের চিত্রই নয়, বরং দেশের প্রশাসনিক দুর্বলতাও তুলে ধরেছে। ড. ইউনূস আশা প্রকাশ করেন, এই প্রতিবেদন জাতির জন্য শিক্ষণীয় হবে এবং ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শুদ্ধি প্রক্রিয়ায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
“সমস্যার গভীরতা আমরা যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশি,” বলেন ড. দেবপ্রিয়। জনগণের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা, যা সরকার ও প্রশাসনের জবাবদিহিতা বাড়াতে সহায়ক হবে।
repoter